Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 11:07 pm

সুখ হারানো মানুষের আখ্যান অসুখপাখি

প্রত্যাশার সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে চলে জীবন। ভাবনার বিপরীতে হাঁটে জীবনের গল্পগুলো। পরিস্থিতি কখনও কখনও এতটাই অবাধ্য হয়ে ওঠে যে, প্রত্যাশাগুলো চরমভাবে হোঁচট খায়। নিয়তি মানুষের স্বপ্নের বিপরীত গল্প লেখে। যে গল্প পড়ে চমকে উঠতে হয়, হতাশ হতে হয়, স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। প্রত্যাশার সঙ্গে দ্বন্দ্বমুখর এমন এক কাহিনি উঠে এসেছে সোহেল নওরোজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অসুখপাখি’তে।

লেখক বইটির ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, এটি ৯০ দশকের গ্রামবাংলার গল্প। গল্পের চরিত্রগুলো আমার চেনা। অনেক ঘটনাই নিজের চোখে দেখা। পারিপার্শ্বিক থেকে চরিত্র নিয়ে উপন্যাসে রূপায়ণের কাজটি করেছেন তিনি যতেœর সঙ্গে, করেছেন আদর দিয়ে। এ কারণে শাফায়েত, তার বাবা হাজী শামসুদ্দীন শেখ, মা আজিফা খাতুন মুহূর্তে আপন হয়ে ওঠে। যেন এই বাড়ির সঙ্গে লেখকের কত চেনাজানা, কতদিনের সম্পর্ক!

মণ্ডলবাড়ির মানুষগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় আয়েশা, তার বোন আমেনা কিংবা তাদের বাবা-মা কিংবা কাজের লোক কেউই দূরের নন। আমেনার বিয়ের যে উত্তাপ লেখক তৈরি করেছেন, তা গ্রামের কারও অচেনা নয়। এ চেনা দৃশ্যগুলো হঠাৎ বেদনাতুর হয়ে ওঠে। প্রত্যাশার বিপরীতে ঘটে একের পর এক ঘটনা, দ্রুতই ঘটে। আমেনার আত্মহত্যা বা শাফায়েতের অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি বুকের ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়। বারবার মনে করিয়ে দেয়, জীবন বোধহয় এমনই! কখনও আনন্দমুখর, কখনও খুব নিষ্ঠুর!

উপন্যাসের প্লট হিসেবে ‘অসুখপাখি’র গল্পটি চমৎকার। লেখকের বর্ণনার গুণে তা আরও প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে। পড়তে গিয়ে একবারের জন্যও ছন্দহারা হতে হয়নি। এটাই একজন ঔপন্যাসিকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। যে চ্যালেঞ্জ দারুণভাবে উতরেছেন সোহেল নওরোজ। যাত্রাপালার নায়িকা চুমকির সঙ্গে শহীদের প্রণয়চিত্রটিকে যেভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন, তার তারিফ করতেই হয়। চুমকিকে নিয়ে লেখক যে খেলাটা খেলেছেন, তা শুরুতে ধরা যায়নি। অথচ আমেনার মর্মান্তিক পরিণতির জন্য চুমকিকেই দায়ী করে সবাই। যদিও প্রেম-ভালোবাসা বা মানবিক সম্পর্ক বলে-কয়ে হয় না। তাদের ক্ষেত্রেও হঠাৎ হয়েছে, যা মেনে নিতে পারেননি শহীদের স্ত্রী আমেনা। বোধ হয় এ দেশের সব নারীই এমন। স্বামীর ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে চায় না। প্রয়োজনে আমেনাদের মতো জীবনও বিসর্জন দেয়।

শাফায়েতের পরিণতির সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপট প্রচ্ছন্নভাবে হলেও মিলে যায়। নিয়তির শিকার হয়ে তাকে জেল খাটতে হয়। অপরাধীরা বহাল তবিয়তে বাইরে থেকে যায়। তিনি ছাড়া পান না, উল্টো বাবাকেও হারান। উপন্যাসের শেষে এসে অজান্তে শাফায়েতের জন্য চোখের কোণ ভিজে যায়। তার পরিণতি যেন আর কারও না হয়, সেটাই প্রার্থিত হয়ে ওঠে।

‘অসুখপাখি’ উপন্যাসে একই সঙ্গে গ্রামীণ সংস্কৃতি, ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা, সামাজিক কুসংস্কার, গ্রাম্য রাজনীতি ও বিচারহীনতাকে তুলে আনা হয়েছে গল্পের আদলে। এতে করে ঘটনার পর ঘটনা এসেছে। উত্তেজনা স্রোতের মতো বয়ে চলেছে, গল্পের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়নি। এক অধ্যায়ের পর আরেক অধ্যায় পড়ার আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। মোট কথা, একটি ভালো উপন্যাস পড়ার পূর্ণ তৃপ্তি দিয়েছে সোহেল নওরোজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অসুখপাখি’।

ধরন: উপন্যাস

লেখক: সোহেল নওরোজ

প্রচ্ছদ: হিমেল হক

প্রকাশক: কুঁড়েঘর প্রকাশনী

পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১০১

দাম: ২৫০ টাকা

  কৌশিক হাসান