রেজাউল করিম খোকন: শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী দুঃশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সব ক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল সারাদেশ। লাখ লাখ বীর জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল মৃত্যুর পরোয়া না করে। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছেন তার অনুগত পুলিশ বাহিনী এবং তার পোষ্য ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ভয়াবহতম গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
ইতোমধ্যেই এ সম্পর্কিত নানা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। দেশের তরুণ প্রজš§ দেশ নিয়ে একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তারা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। এবারের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা; যাদের কেউ কেউ ছাত্র সংগঠন করলেও বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী। আন্দোলনের নেতৃত্বেও তারা বিরল যূথবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন।
শতাধিক সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক নিয়ে অতীতে কোনো আন্দোলন এ দেশে গড়ে ওঠেনি। তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যও ছিল তা-ই। যেহেতু সরকারি চাকরির সংখ্যা সীমিত, তাই তাদের দাবি ছিল প্রধানত মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ প্রদান করতে হবে। এই প্রজš§ একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের মাধ্যমে ছাত্ররা তাদের সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছে।
লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়াও গত ১৬ বছরের অপশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, অবাধ দুর্নীতির সুযোগের বিনিময়ে এগুলোয় পদলেহী ও আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্তদের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদান। আগামী সরকারের তাই একটি বড় কাজ হবে, এসব জঞ্জাল অপসারণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ৬ শতাধিক মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু নয়, সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের এই আন্দোলনে দেখা গেছে এমন কিছু দৃশ্য; যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী দিনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কার্যত একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় তৈরি করেছিলেন কয়েক স্তরের সুবিধাভোগী শ্রেণি। যেখানে প্রথমে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের। যোগ্যতা বা মেধা নয়, তারা ছিলেন একটি মাস্তানচক্র। এই চক্রটি নানা ধরনের প্রপাগান্ডা চালিয়ে তথাকথিত স্মার্ট বাংলাদেশের সেøাগান দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লোপাটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদের সঙ্গে ছিল একটি ব্যবসায়ী অলিগার্ক শ্রেণি ও প্রশাসনের বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনে পুলিশ, বিজিবি ও বেসামরিক আমালতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেখানে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির একমাত্র যোগ্যতা ছিল ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা। বিচার বিভাগে নিষ্ঠুর কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যত বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে ফাঁসি প্রদান করা।
পদোন্নতি ও সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে মানদণ্ড হয়ে উঠেছিল কে কত বেশি ফাঁসির রায় দিতে পারবেন। এ ঘটনা জেলা আদালত, তথাকথিত আন্তর্জাতিক আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত দেখা গেছে। আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নমূলক শাস্তি চাপিয়ে দেয়া। ফলে বাংলাদেশ থেকে বিচার ও আইনের শাসন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সামগ্রিকভাবে একটি রক্ত পিপাসু পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের পক্ষে শেখ হাসিনার সাফাই ছিল, ভুক্তভোগীরা সবাই ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। তিনি যে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করেছিলেন, সেখানেও তিনি স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তির কথা বলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে গেছেন। দিয়েছেন অন্যায় ও অপকর্মের অবাধ লাইসেন্স। এ বিভাজনের কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি তরুণ-কিশোর ছাত্রছাত্রীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলনে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বহুল আলোচিত সেøাগান ছিলÑ‘তুমি কে-আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে-কে বলেছে স্বৈরাচার-স্বৈরাচার।
ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণরা শেখ হাসিনার বিভাজনের রাজনীতির কৌশলটি শুরুতেই ধরে ফেলেছিলেন। এ কারণে তারা সব ক্ষমতাদর্শের শিক্ষার্থীদের একত্র করতে পেরেছিলেন। সেখানে একমাত্র পরিচয় ছিল ছাত্র। ফলে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে একসময় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। কারণ, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এটি এমন এক আন্দোলন যেখানে বিভক্তি ও বিভাজন নেই। ডান-বাম, ইসলামপন্থি সবাই ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। ফলে জনবিচ্ছিন্ন শেখ হাসিনার শাসনের পতন ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনা তার ১৮ বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশে মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিলেন। তার শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিল ভয় দেখানো।
এই ভয় দেখানোর কাজটি করা হতো প্রশাসন, আদালত এবং তার দলের পেটোয়া বাহিনীর মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের বহু মানুষ ভয়ে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, দেশের মানুষ তার নিপীড়নমূলক শাসন মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ কখনোই তার ফ্যাসিস্ট শাসন মেনে নেয়নি; তারা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের অপেক্ষায় ছিলেন। ছাত্ররা মানুষের কথা বলার সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে শেখ হাসিনা একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো করে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষ যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক তা তিনি কখনোই মনে করতেন না। তিনি কার্যত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একটি জমিদারিতে পরিণত করতে চেয়েছেন, যার একমাত্র শাসক হচ্ছে তার পরিবার। ফলে তার পতনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আক্রোশের প্রকাশ ঘটে গণভবনে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ে।
পতনের উল্লাস প্রকাশ করে। শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দুঃশাসনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস চাপা দিয়েছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতন যেমন নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভয়ানক এক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নতুন পথে এগিয়ে যেতে হবে। দেশে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, অনেকে একে বিপ্লব বলছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলেছে। জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা একটি বৈপবিক পরিবর্তন।
যে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার পতন হলো, তা এক ধরনের স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা ছিল। এর ভিত্তিই ছিল বিরোধী সব সংগঠন, সেটা ব্যাংকই হোক, কোম্পানি বা রাজনৈতিক দল হোকÑএগুলো ভেঙে ফেলা, দুর্বল করা এবং ভেতর থেকে চূর্ণ করে দেয়া। আর জনগণের মধ্যে একটা ভয় ছড়িয়ে দেয়া যে আমার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে গায়েব হয়ে যাবে। ছাত্রদের আন্দোলন যখন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হলো, এটা উৎখাত হলো। এ সাফল্যের কারণ এর কোনো সংগঠিত ভিত্তি ছিল না। আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছিল গোলাগুলি করে ভয়টাকে পুনরুৎপাদিত করতে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হলো। যে শক্তি সরকারব্যবস্থাকে চূর্ণ করল, সেটি অসংগঠিত রাস্তার শক্তি। এরা কিন্তু আজীবন রাস্তায় থাকতে পারবে না। এখন আমাদের অর্জনগুলো বাস্তবমুখী করতে হলে নিয়ম-কানুনের মধ্যে আসতে হবে। পাশাপাশি সেই নিয়মগুলোকে কার্যকর ও সমর্থন করার মতো সংগঠন তৈরি করতে হবে। আমাদের ভালো নিয়মকানুন আছে।
কিন্তু যারা ক্ষমতাশালী সংগঠন বা সংস্থা, তারা যদি এই নিয়ম-কানুন মানতে না চায় এবং তাদের ঠেকানোর মতো যদি কোনো পাল্টা সংগঠন না থাকে, তাহলে আইন যা-ই থাকুক, তা কার্যকর হবে না। আমাদের সেই পাল্টা শক্তি নেই। আওয়ামী লীগ তার সব পাল্টা শক্তি ভেঙে দিয়েছিল। সমাজে যেসব দাবি উঠছে বা যেসব অর্জন আমাদের হয়েছে, তা টেকসই করার জন্য এখন দরকার পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট। এ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে কাজ করবে? আমাদের দেশে বিভিন্ন শক্তি আছে, স্বার্থ আছে। রাজনীতির ভিন্নতা আছে। সে ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে হতে পারে? রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হচ্ছে, সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠিত শক্তি ও নিয়মকানুন।
এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় বা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রবর্তন হলো, একটা দেশে কোন আইন কার্যকর হবে এবং সমাজে কী ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, তা বোঝার জন্য সমান্তরালভাবে দেখতে হবে দেশটিতে সংগঠিত সংগঠনগুলো কারা। আমরা বাংলায় সব কয়টিকে প্রতিষ্ঠান বলি। আমাদের ইনস্টিটিউশন ও অর্গানাইজেশনকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। রুলস অব দ্য গেম হলো ইনস্টিটিউশন। অন্যদিকে অর্গানাইজেশন হচ্ছে সংস্থা-রাজনৈতিক দল, ইউনিভার্সিটি, কোম্পানি কিংবা একটা ব্যাংক।
নিয়ম-কানুন এসব সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যারা বা যে সংস্থা ক্ষমতাসীন, তারা নিয়ম মানতে চায় না। যারা ক্ষমতাবান, তারা পুলিশ কিনে নেবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিনে নেবে, নির্বাচন কমিশন কিনে নেবে। কিনতে না পারলে ভয় দেখাবে। আমাদের সমান্তরাল কিছু সংগঠন তৈরি করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, কেবল একটা কোম্পানি পণ্য আমদানি করবে, এমন নয়। একসঙ্গে যদি ৫০টি কোম্পানি পণ্য আমদানি করে, তাহলে একজন আইন না মানলে অন্যরা প্রতিবাদ করবে।
গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের দুঃশাসন আমাদের সব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেড ইউনিয়ন, কোম্পানি, ব্যাংকÑকিছুই অবশিষ্ট নেই। সুতরাং আমরা এখন যত সুন্দর আইনই করি না কেন, তা কাজ করবে না। তবে হতাশ হলে চলবে না। আমাদের একদিকে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে, অন্যদিকে সংগঠনও তৈরি করতে হবে। তবে খুব দ্রুত সবকিছু কাজ করবে না। কোনো কোনো সংগঠন দ্রুত তৈরি করা যাবে, কোনো কোনোটি তৈরি করতে পাঁচ-ছয় বছর লেগে যেতে পারে। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক দিক এটাই। কালকেই যদি আমরা নরওয়ের মতো দেশ হতে চাই, তাহলে সব ধসে যাবে। তখন পুরোনো শক্তি বলবে, দেখো ওরা পারে না, আমরাই পারি। পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট হলো ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে আইনের সামঞ্জস্য। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানে এই না যে, সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটা রুমে আলোচনা করলাম যে কোনো বিষয়ে আমরা সবাই একমত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান নতুন করে লেখার দাবি উঠছে। বর্তমান সংবিধানের বেশ কিছু বিধিবিধান স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের জš§ দেয়, এমন অভিযোগ আছে। সব ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে একটি নিখুঁত সংবিধান লেখার দাবি করছেন অনেকে। আমাদের সমাজ এর জন্য কতটা প্রস্তুত? আমাদের সংবিধান যে ত্রুটিপূর্ণ, তা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো মানুষই সম্ভবত দ্বিমত করবে না। এখন একটা সুন্দর সংবিধান লেখা হলো। কিন্তু এটাকে কার্যকর করার সাংগঠনিক শক্তি থাকতে হবে।
কিছু করার আগে আমাদের এদিকে নজর দিতে হবে। নাগরিক সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠনÑএসব সংগঠন যদি নিয়মের ব্যত্যয় করে, তাহলে একই রকম সংগঠনগুলোকে সংযত করা যাবে কি না, সেটি নিশ্চিত করতে না পারলে কিন্তু আইনের কোনো মূল্য নেই। তাহলে কি সংবিধান পরিবর্তন করেই তা নিশ্চিত করতে হবে, নাকি নাগরিক শক্তি গড়ে তোলার দিকে আগে নজর দিতে হবে? এটা সমান্তরালভাবে করতে হবে। সংবিধানে বাস্তব অবস্থাকে প্রতিফলিত করতে হবে। আগে আইন লিখে পরে বলবেন যে সমাজকে সেভাবে সাজাতে হবে, সেটা হয় না। আগে দেখতে হবে সমাজ কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে, পরে সংবিধানকে তার সঙ্গে মেলাতে হবে। বর্তমান সংবিধানে কিছু বিষয় আছে, যা এটাকে অকার্যকর করে দেয়। আমাদের এখানে কিছু মতাশালী সংগঠন আছে, যারা আইন না মানলে তার কোনো ক্ষতি হয় না। একটা রাজনৈতিক দল টাকা ওঠাচ্ছে চোরাকারবারি, আদম ব্যবসায়ী কিংবা এস আলমের মতো টাকা পাচারকারী-এদের কাছ থেকে। ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলোকে কোম্পানি বা ট্রেড ইউনিয়ন যে টাকা দেয়, তা আসে আইনি উৎস থেকে। তারা চায় না এসব রাজনৈতিক দল এমন কাজ করুক, যা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবাই আইন ভাঙতে চায়। কিন্তু কোনো কোম্পানি আইন না মানলে তাদের সঙ্গে কেউ কন্ট্রাক্টে বা চুক্তিতে যাবে না। পুরো ব্যবস্থাটাই কন্ট্রাক্টে চলে। এ দেশে দলেরও ক্ষতি হয় না, এস আলমেরও ক্ষতি হয় না। এরা শুধু ক্ষতির মুখে পড়ে এসব অভ্যুত্থানের সময়। এদের দৈনন্দিন কাজে বাধা আনতে হবে, কারণ অভ্যুত্থান প্রতিদিন হবে না। আমরা এখন যা-ই সংস্কার করি, সেটা মতার সঙ্গে মিলিয়ে করতে হবে। সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে এখন নানা রকমের সংস্কারের দাবি উঠছে। কখনও কখনও তা পরস্পরবিরোধীও মনে হয়।
কিন্তু একটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব সংস্কারের দাবি কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে? ক্ষমতার যে উৎস, তা অসংগঠিত হতে পারে। কিন্তু তারা রাস্তায় আছেন, একটি সত্যিকার শক্তি। এর ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখনই সম্ভব। দু-একটা উদাহরণ দিই। এখনই সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব পরিবর্তন করা সম্ভব। এটা না করতে আটকে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেসব লোক টাকা চুরি করে বিদেশে নিয়ে গেছেনÑগভর্নর ও অর্থ উপদেষ্টা সে বিষয়ে কথাও বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এখনই সম্ভব। তাদের সব সম্পদ জব্দ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশে যেসব বীভৎস চুক্তি করেছে বিদ্যুৎ কিংবা অন্যান্য খাতে, ১০ টাকার জিনিসের জন্য ইতোমধ্যে ১০০ টাকা দিয়ে দিয়েছি আমরা, এগুলো প্রকাশ করতে হবে। আদানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, সে সম্পর্কে ভারতের লোকজনই বলছে, এটা অবিশ্বাস্য চুক্তি। অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা নিয়ে যাচ্ছে ঝাড়খণ্ডে, যেখানে কয়লা আছে। আগের সরকার গোপন চুক্তির মাধ্যমে নিজের লোকদের মাধ্যমে টাকা লুট করেছে এবং আইন পাস করছে যে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এই আইন এখনই বাতিল করা যায়, কারণ এটা বেআইনি। ক্ষমতার উৎস ভোট হতে পারে, আবার রাস্তা থেকেও আসতে পারে। আমরা চাই, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের নৃশংসতার একটি নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হোক। সেই সঙ্গে পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হোক।
নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করতে হবে। এরপর একটি অবাধ, সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে সব রাজনৈতিক দল ও মতের লোকজনদের। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধার করার জন্য সুশাসন এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা মোকাবেলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে শক্তিশালী ও সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।