শেখ আবু তালেব: খেলাপি হওয়া ঋণ খেলাপি না দেখিয়েই পুনঃতফসিল করছে ব্যাংকবহির্ভূত কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)। এসব ঋণ পুনঃতফসিল করা হচ্ছে কোনো ধরনের আদায় ছাড়াই। আবার এসব ঋণের বিপরীতে অনাদায়ী বিপুল পরিমাণ সুদ আদায় না হওয়া সত্ত্বেও তা আয় খাতে স্থানান্তর হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন শক্তিশালী হলেও বাস্তবে ওই পরিমাণ আয় তাদের কাছে থাকছে না। এমন কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভবিষ্যৎ ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কোনো ঋণ বা লিজ পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা হয় একটি নীতিমালার আলোকে। এতে উল্লেখ থাকে ঋণ বা লিজটি কোন সময়ের, কতবার পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা হয়েছে, মেয়াদ কত হবে, অনাদায়ী সুদ আদায় কোন খাতে থাকবে, শ্রেণিকৃত ঋণের গুণগত অবস্থা, কী কী শর্তে পুনঃতফসিল করা যাবে, ডাউন পেমেন্ট কোন পদ্ধতিতে হবে, অশ্রেণিকৃত ঋণ বা লিজ পুনঃতফসিল করা যাবে কি না, এসব বিষয়। প্রতিটি স্তরের সব বিষয়েই নীতিমালায় বিস্তারিত বলা রয়েছে।
দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট সার্কুলার থাকলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় তা লিখিত আকারে নেই। সাধারণত দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের নীতিমালাই অনুসরণ করে থাকে।
সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বা লিজ পুনঃতফসিল ও পুনঃর্গঠনে অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে গ্রাহকদের। কিছু ক্ষেত্রে অনৈতিক লেনেদেনও হচ্ছে। একটি ঋণ বা লিজ কতবার পুনঃতফসিল করা যাবে, বা এর মেয়াদ কত হবে, তার কোনো পৃথক নির্দেশনা নেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেলায়। ফলে আগে ব্যাংকের জন্য জারি করা নীতিমালা অনুসরণ করলেও এখন তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন।
সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা যাচ্ছে ঋণ বা লিজ পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে। খেলাপি না দেখাতে কোনো ধরনের ডাউন পেমেন্ট বা আদায় ছাড়াই পুনঃতফসিল করা হচ্ছে ঋণ। অনেক ঋণ খেলাপি হলেও তা শ্রেণিকরণ করা হচ্ছে না। আবার বকেয়া ঋণের সুদ আদায় না হলেও তা আয় খাতে স্থানান্তর করা হচ্ছে। যদিও কোনো অনাদায়ী সুদ আদায় না হওয়া পর্যন্ত আয় খাতে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুদের অর্থ আদায় না করেই তা আয় খাতে দেখাচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের কাছে নগদ অর্থ আদায় না হলেও কাগজে-কলমে আয় বাড়ছে।
এমন কর্মকাণ্ড আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভবিষ্যৎ ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় পরামর্শ এসেছে, ঋণ বা লিজসংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ সার্কুলার জারি করার সময় হয়েছে।
এ বিষয়ে দেশের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাধারণত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের মতোই সবকিছু পরিচালনা করে। এজন্য ব্যাংকিং নীতামালা অনুসরণ করে। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়েই সবকিছু করা হয়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই নিজেদের সুনামের স্বার্থে সবকিছু নিয়মের মধ্যেই করে থাকে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে অনৈতিক পথ অবলম্বন করতে পারে। এটি সত্য যে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় এ নিয়ে পৃথক কোনো সার্কুলার নেই। যদিও ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন নতুন কোনো সার্কুলার হলে তা অবশ্যই সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করবে।
বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি হওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করতে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির অন্যূন ১৫ শতাংশ বা মোট বকেয়ার ২০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম, তা নগদে পরিশোধের পরেই প্রথমবার পুনঃতফসিল করা যাবে। দ্বিতীয়বারে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির অন্যূন ৩০ শতাংশ বা মোট বকেয়ার ২০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম ও তৃতীয়বারের বেলায় অন্যূন ৫০ শতাংশ বা মোট বকেয়ার ৩০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম, তা নগদে পরিশোধ করে পুনঃতফসিল করা যাবে। কিন্তু ঋণটি কতবার পুনঃতফসিল করা যাবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। কিন্তু উল্লেখ করা আছে, ঋণ হিসাব পুনঃতফসিল করার পর তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে জানাতে হবে। অযৌক্তিকভাবে ঋণ বা লিজ হিসাবের পুনঃতফসিল করতে হলে গুণগত মানের ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশি-বিদেশি সব মিলিয়ে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের আকার প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণের গড় হার আট শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে এরই মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে সম্প্রতি পিপলস লিজিং নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের (বন্ধ) প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অনিয়মে ঋণ পুনঃতফসিল
সুদ আদায় না হলেও আয় খাতে স্থানান্তর করছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান
