প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জে এ বছর ১৩ লাখ টনের ওপর বোরো ধান উৎপাদন হয়েছিল। যেখান থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কেজিপ্রতি দুই টাকা ধানের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল ১ হাজার ২৮০ টাকা করে মণপ্রতি। এ অবস্থায় ২৯ হাজার টন ধান এই জেলার কৃষকদের কাছ থেকে কিনতে খাদ্য বিভাগকে তিন মাসের সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে খাদ্য বিভাগকে ১৩ লাখ টন ধান থেকে নামমাত্র ১৮ হাজার টন ধান কিনতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। ফলে এ নিয়ে টানা দুই বছর ধরে সুনামগঞ্জের কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ।
এর আগেও ২০২৩ সালে এ জেলার কৃষকদের কাছ থেকে ১৭ হাজার ৪৮৩ টন ধান কেনার কথা থাকলেও তৎকালীন সরকার মাত্র ১৫ হাজার ৫৫৪ টন ধান কিনতে সক্ষম হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে প্রতিবছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে ঘরে তুলতে হয় সোনালি ধান। যে ধান ঘরে তুলতে পারলেই একদিকে যেমন হাসি ফুটে কৃষকের মুখে অন্যদিকে পুরো বছর আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কাটে কৃষকদের। তবে প্রতি বছর এ জেলায় ধানের উৎপাদন বাড়লেও বিগত সরকার নামমাত্র কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করত। সেই ধান আবার সরকারি গুদামে দিতে গিয়ে সহজ-সরল কৃষকদের পড়তে হয় নানা হয়রানি ও সিন্ডিকেটের কবলে। ফলে গুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। অন্যদিকে গত দুই বছর ধরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না খাদ্য বিভাগ।
এই যেমন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষক নূর মোহাম্মদ। সরকারি গুদামে ধান দিতে গিয়ে তার রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। যার কারণে এখন আর গুদামে ধান দিতে আগ্রহী নন তিনি। তাই এ বছর প্রায় ১২০ মণ বোরো ধান ঘরে তুলতে পারলেও তার মধ্যে ৬০ মণ ধান বছর কেন্দ্রিক খাওয়ার জন্য রেখে দিয়েছেন। আর প্রায় ৬০ মণ ধান সরকারি মূল্যর চেয়ে কম দামে ১ হাজার ১০০ টাকা মণে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করেছেন।
কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, অনেক কষ্ট করে ফলানো ধান সরকারি মূল্য বিক্রি করার জন্য গুদামে নিয়ে গেলে মাপ ঠিকমতো পাওয়া যায় না। সেই ধানের টাকা ব্যাংক থেকে আনতে গেলে সেখানেও ঘুস দিতে হয়। যার কারণে আমরা এখন আর গুদামে ধান দিই না।
শুধু কৃষক নূর মোহাম্মদ নন, চলতি বছর জেলার প্রায় ১০ লাখ কৃষক ১৩৭টি হাওরে দুই লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ করেছিলেন। যেখান থেকে প্রায় ১৩ লাখ টনের ওপরে ধান উৎপাদন হলেও বিগত সরকার নামমাত্র ২৯ হাজার টন ধান কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করে এই জেলা থেকে।
তবে জেলার খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, ৭ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ তিন মাসে সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, বিশ্বম্ভরপুরসহ ১২ উপজেলার কৃষকদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার ২৯ হাজার টনের মধ্যে ১৮ হাজার ৮৪১ মেট্রিক টন ধান কিনতে সক্ষম হয়েছে খাদ্য বিভাগ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৩ দশমিক ২০ শতাংশ কম।
সরকারিভাবে ধান বিক্রি না করার কারণ হিসেবে কৃষক ডালিম, হাবিব ও আতিকুর বলছেন, এত বছর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হস্তক্ষেপে গুদামে ধান নেয়া হতো। কিন্তু যখন সাধারণ কৃষক ধান ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে গেলেও তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই আমরাও বাধ্য হয়ে ফড়িয়াদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতাম। তবে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম ভূঞা বলেন, চলতি মৌসুমে দাম বাড়িয়েও কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ হঠাৎ করে তিনদফা বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় এ বছর কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, কৃষকদের সরকারি গুদামে ধান দিতে এসে হয়রানি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।