সুন্দরবনে আগুন: সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন

 

রিয়াদ হোসেনঃসুন্দরবন আমাদের অগাধ সম্পদের আধার। বছরের পর বছর মাতৃস্নেহে আগলে রাখা সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাসে ভয়াবহ ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে আসছে এই সুন্দরবন। দেশের উপকূলে বসবাসরত সাধারণ জনগণ আয়লা, সিডর, আম্পানে বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে। বলা যায়, প্রতিবছরই আঘাত হানা ছোট-বড় এসব ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবলীলা ও গতিকে দুর্বল করে দিয়েছে পৃথিবীর একক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। এতে তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে এবং উপকূলীয় এলাকা রক্ষা পেয়েছে। তবে সুন্দরবনের গাছপালা ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মানুষের অমানবিক আচরণ, দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে আজ বিপর্যস্ত সুন্দরবন। বৃক্ষনিধন, বন্যপ্রাণী হত্যা, পাচারসহ নানা কারণে আজ বিপর্যয়ের মুখে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আমাদের ঐতিহ্য। সাম্প্র্রতিক সময়ে সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বারবার সুন্দরবনের নির্দিষ্ট কিছু অংশে আগুন লেগে বনের গাছপালা পুড়ে যাচ্ছে। মৃত্যু ঘটছে অনেক বন্য প্রাণীরও। এভাবে যদি মানবসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক কারণে সুন্দরবন ধ্বংস হতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

সুন্দরবন বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এ নিয়ে ২৫ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। বন বিভাগের হিসাবমতে, বিগত ২৪ বারের আগুনে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমির ক্ষতি হয়। এর আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা। কিন্তু আশ্চর্য হওয়ার মতো একটি ঘটনা হলো, ২৫ বারই আগুন লেগেছে সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে উল্লেখযোগ্য কোনো আগুন লাগার ঘটনা ইতোপূর্বে শোনা যায়নি। তাহলে এই আগুনের সূত্রপাত কি? কেন এই অঞ্চলে বারবার আগুন লাগছে? সেটা প্রাকৃতিক কোনো কারণ নাকি মানবসৃষ্ট কারণেÑএমন হচ্ছে সেই বিষয়টা পরিষ্কার হয় না। আমরা দেখি, কোনো ঘটনা ঘটার পরপরই তার কারণ অনুসন্ধানে একটি টিম গঠন করা হয়। নাম দেয়া হয় তদন্ত কমিটি। তাদের সময়ও বেঁধে দেয়া হয় ফলাফল উপস্থাপন করার জন্য। আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার কোনো বাস্তবায়ন হয় না। সেসব কারণ, দায়ীদের খুঁজে বের করা সবই ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকে বন বিভাগের টেবিলে। কিছুদিন পর বনে গাছ কাটা, বনসংলগ্ন নদীতে অবৈধ মাছ শিকার কিংবা বাঘের মৃত্যুর মতো ঘটনায় পেছনের সবকিছু আমরা ভুলে যায়। এজন্য এসব ঘটনার অন্তরালে কী ঘটেছে, সেটা অনুসন্ধান করে প্রকাশ করা বা সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন অতি গুরুত্বপূর্ণ।

এর আগে সুন্দরবনে যতবার আগুন লেগেছে, তা সবই শুষ্ক মৌসুমে এবং উঁচু অঞ্চলে। যেখানে সচরাচর জোয়ারের পানি পৌঁছাতে পারে না। ফলে আগুন লাগলে তা অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ক্ষতির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক সময় বনে যাওয়া কাঠুরি, জেলের সিগারেটের আগুন কিংবা মৌয়ালদের চাক ভাঙার কাজে ব্যবহারিত আগুনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সর্বশেষ সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। যার কারণ এখনও জানা যায়নি। পূর্বের মতো এবারও আগুন লাগার কারণ চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আসলে এই তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে কিনা সেটা বরাবরের মতোই প্রশ্ন থেকে যায়। এ কারণে যারা সুন্দরবনের ওপর জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে তাদের সচেতন করা তোলাটা খুব জরুরি। তাদের অসাবধানতার কারণে যেন এমন বড় বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আগুন দেয়ার বিরুদ্ধে যে আইন রয়েছে, সেটিরও বাস্তবায়ন করা দরকার। পাশাপাশি আগুন লাগার প্রকৃত কারণ উদঘাটন এবং বন সংরক্ষণে প্রণীত সকল আইনের যথাযথ প্রয়োগে বন বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

শিক্ষার্থী

সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০