নিজস্ব প্রতিবেদক: বাঘ জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ১২৫টি বেঙ্গল টাইগারের সন্ধান পাওয়া গেছে; এই সংখ্যা বলছে, ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় বাঘ বেড়েছে ১১টি। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে ২০২৩-২৪ সালের বাঘ জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরির্বতন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে ২০২৩-২৪ সালে সুন্দরবনে পরিচালিত বাঘ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার বনে বাঘের ঘনত্ব পাওয়া যায় ২ দশমিক ৬৪টি। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৫ সালের তুলনায় বাঘের সংখ্যা ১৭ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া বাঘ জরিপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া গেছে বলে জানান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ সালের বাঘ জরিপে ২১টি বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া গেছে, যেখানে ২০১৫ ও ২০১৮ সালের জরিপে মাত্র পাঁচটি করে শাবকের ছবি পাওয়া গিয়েছিল।
‘তবে বাঘ শাবকের সংখ্যা জরিপের ফলাফলে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কারণ ছোট থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাঘ শাবকের মৃত্যুর হার অনেক বেশি হয়ে থাকে,’ বলেন রিজওয়ানা। বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার -আইইউসিএন বাঘকে বাংলাদেশে অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ২০১০ সালে ১৩টি টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রির মধ্যে বর্তমানে ১০টি দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া, চীন থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বাঘ রয়েছে। বাকি তিনটি দেশ অর্থাৎ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের বনাঞ্চল থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ৮৪০টি।
জরিপের মাধ্যমে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ, বনে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি বাঘসংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় এবং বাঘ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়। অনুষ্ঠানে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য সর্বপ্রথম ২০১৫ সালে আধুনিক ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে বাঘ জরিপ করা হয়। জরিপে ১০৬টি বাঘের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ছিল ২ দশমিক ১৭টি। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ছিল ২ দশমিক ৫৫টি। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বাঘ বৃদ্ধি পায় শতাংশ।
তৃতীয় পর্যায়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জরিপ শুরু হয়ে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শেষ হয়।
জরিপে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা, চাঁদপাই ও শরনখোলা রেঞ্জে চারটি ব্লকে ৬০৫টি গ্রিডে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। চার বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রতিটি গ্রিডে বাঘের গতিপথ, বিচরণ, অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সঙ্গে দুটি ক্যামেরা বসানো হয়। ৬০৫টি গ্রিডে পর্যায়ক্রমে এক হাজার ২১০টি ক্যামেরা মোট ৩১৮দিন রেখে দেয়া হয় এবং ৩৬৮টি গ্রিডের ক্যামেরায় বাঘের ছবি পাওয়া যায়। ১০ লক্ষাধিক ছবি ও ভিডিও থেকে শুধুমাত্র বাঘের ছবি পাওয়া যায় ৭ হাজার ২৯৭টি। এত বিপুল সংখ্যক বাঘের ছবি এর আগে পাওয়া যায়নি। ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঘের ছবি তোলার মূল উদ্দেশ্য হলো বাঘের দেহে যে ডোরাকাটা দাগ আছে, তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা। বাঘের ডোরাকাটা দাগ ও দেহের বিভিন্ন অংশের ছবি বিশ্লেষণ করে একক ও অনন্য বাঘের ছবি শনাক্ত করা হয়।
জরিপকালে প্রাপ্ত বাঘের ছবি ও অন্যান্য তথ্য উপাত্তগুলো সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে নিয়োজিত বাঘ বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ এবং যাচাই বাছাই করে বাঘের সংখ্যা ও বাঘের ঘনত্ব নিরূপণ করেন।
এছাড়া জরিপের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর ভারত, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মতামত নেয়া হয়। উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, বাঘ সংরক্ষণে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম নিয়েছে। এর মধ্যে বাঘসহ সুন্দরবনের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও প্রজননের উদ্দেশ্যে বনের ৫৩ দশমিক ৫২ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সেখান থেকে সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব হ্রাসে লোকালয়সংলগ্ন এলাকায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ নাইলনের ফেন্সিং তৈরি করা হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ের জন্য বনের ভেতরে ১২টি মাটির উচু কিল্লা/ঢিবি নির্মাণ করা হয়েছে। বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৩ লাখ টাকা এবং গুরুতর আহত ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে বলে জানান উপদেষ্টা রিজওয়ানা। তিনি বলেন, বাঘসংক্রান্ত অপরাধ উদ্ঘাটনে তথ্য প্রদানকারীকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সম্মানী দেয়া হচ্ছে। লোকালয়ে চলে আসা বাঘকে পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেবার জন্য স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে এবং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বাঘ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর বিশ্ব বাঘ দিবস পালনসহ বিভিন্ন গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ, বন অধিপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এম এ আজিজ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো, সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।