Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 1:07 am

সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিন

 

সুন্দরবন হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ লোনাপানির বা ম্যানগ্রোভ বন। এ বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে শত শত প্রজাতির গাছ, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী, অসংখ্য প্রজাতির পাখি ও বিপুল মৎস্য সম্পদ রয়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন পাঁচটি জেলার কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় এ বনের ওপর ভর করে। তাছাড়া বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ বন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এই প্রাকৃতিক বনভূমির সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

দৈনিক শেয়ার বিজে গতকাল ‘তদন্ত হলেও সমাধান নেই: সুন্দরবনে ২২ বছরে ৩২ বার আগুন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, আগুন লাগার পর প্রতিবার এর কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্ত প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি। অগ্নিকাণ্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়। সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন ও অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ এলাকায় প্রতি দুই কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোলঘেঁষে বনের পাশ দিয়ে কাঁটাতার, অথবা নাইলনের রশির নেট দিয়ে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করা।

কিন্তু এসব সুপারিশ কখনও আমলে নেয়া হয়নি। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। সুন্দরবনে ২২ বছরে ৩২ বার আগুন লেগে পুড়ে গেছে প্রায় ৯০ একর বনভূমি। শুধু আগুনেই পুড়ছে না সুন্দরবন, বন্যপ্রাণী ও মৎস্যসম্পদই ধ্বংস করে চলছে প্রতিনিয়ত একশ্রেণির চক্র। আর বন উজাড়িকরণ ও মাত্রাতিরিক্তভাবে সুন্দরবন থেকে নানা সম্পদ আহরণ করায় দ্রুত কমে যাচ্ছে এর আয়তন। এভাবে হ্রাস পেতে থাকলে একসময় বিলীন হয়ে যেতে পারে প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ।

সুন্দরবন যে কেবল কয়েক লাখ মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করে তাই নয়, বরং এটি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সুরক্ষা দেয়। বিশেষ করে ২০০৭ সালে সংঘটিত প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কথা আমাদের মনে আছে। ওই ঝড়ে সুন্দরবন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মাধ্যমে এ বন লাখ লাখ মানুষের প্রাণ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। এতকিছু জানার পরও মানুষ নির্বিচারে এ বন উজাড় করে চলেছে। ফলে দ্রুত কমে আসছে সংরক্ষিত বনের আয়তন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে কমতে বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারে, যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ শতাংশ। এই অবশিষ্ট বনাঞ্চল সুরক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

বৈশ্বিক পর্যায়ে সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯৭ সালে এ বনকে ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের ইউনেসকো। এখানে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসব প্রাণিকূল রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে সার্বিক জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে সুন্দরবনকে অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি এর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলো রক্ষায়ও জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় বিবেচনা করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।