Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:10 am

সুন্দরবন রক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে

সুকান্ত দাস: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ছবি দারুণ সাড়া ফেলেছিল। ছবিটা এমন ছিল, চারটি সন্তানের পেছনে তাদের পিতা দাঁড়িয়ে আছেন এবং অভয় দিয়ে বলছেন যত বিপদই আসুক তার আঁচ তোমাদের গায়ে লাগবে না। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের পেছনেও পিতার মতো ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিস্তীর্ণ বনভূমি। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ম্যাপলক্রাফট’ কয়েক বছর আগে ১৭০ দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১৬টি দেশকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। তার ওপর গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে যতগুলো দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সারাবছর ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের দেশকে। ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস এগুলো আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সবকিছু বিবেচনা করলে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তা হলো একটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ওপর আঘাত হানল, এতে যতটা ক্ষয়ক্ষতির আভাস থাকে তার অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর কারণ, সন্তান রূপ দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের পেছনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করছে পিতাস্বরূপ একটি বনভূমি। হ্যাঁ! সুন্দরবনের কথাই বলছি। দেশের দক্ষিণাঞ্চল তো বটেই বরং সমগ্র দেশকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। পৃথিবীর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ বন। সন্তানের বিপদে পিতা যেমন বুক পেতে দেন, ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তেমনি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের রক্ষার্থে পিতার মতো বুক পেতে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। হাজার বছর ধরে আমাদের রক্ষা করে চলেছে। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০১ সালের আইলা, ২০১৬ সালের  রোয়ানু, ২০১৮ সালের বুলবুল, ২০১৯ সালের ফণী, ২০২০ সালের আম্পানের গতি কমিয়ে দিয়ে সুন্দরবন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করেছে।

কিন্তু সব থেকে পরিতাপের বিষয় হলো, পিতাসম সুন্দরবনের প্রতি আমরা সব সময় অবিচার করেছি। কুপুত্র যেমন পিতাকে কষ্ট দেয় আমরাও ঠিক একই কাজ করছি। নির্বিচারে সুন্দরবনের কাটা হচ্ছে। দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত দেশের দুর্গকে।

সুন্দরবন রক্ষায় ২০ বছর আগে জ্বালানি কাঠ ও চিংড়ি পোনা সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন বিভাগ। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিনিয়ত সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে তারা এসব করছে। অনেক সময় বন বিভাগের লোকজন ও এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে। রক্ষকই যখন ভক্ষক হয় তখন তো আর কিছু করার থাকে না।

সংবাদমাধ্যমের কিছুদিন আগের করা একটি প্রতিবেদন দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। সেখান থেকে জানলাম আন্তর্জাতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনে সুন্দরি গাছ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪৫ হেক্টর জুড়ে ছিল। ২০১৪ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৯৯৫ হেক্টরে। ১৯৮৯ সালে বনের ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৭৭ হেক্টর জুড়ে গেওয়া গাছ ছিল। ২০১৪ সালে তা ৭৪ হাজার ১৭০ হেক্টরে নেমে আসে। বনের ঘনত্ব ও গাছপালার পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য গবেষকরা ১৯৮৯ সালে থেকে পাওয়া সুন্দরবনের স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করেন। এতে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালে সুন্দরবন ঘন বনের পরিমাণ ছিল ৬০ শতাংশ, ২০১৪ সালে তা হয় ৩৮ দশমিক ১৮ শতাংশ।

ঘন বন কমছে, হালকা বন বাড়ছে। নির্বিচারে সুন্দরবনের গাছ কাটার ফলে এমন হচ্ছে। একটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশে কাগজে-কলমে ১৭ শতাংশ থাকলেও বাস্তবে তা আরও কম। যেটুকু বনভূমি রয়েছে তার অধিকাংশই সুন্দরবনে। কিন্তু সেখানে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বনবিভাগকে লুকিয়ে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তখন দুর্যোগ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, সুন্দরবন না থাকলে কলকাতার থেকেও খারাপ অবস্থা হতো ঢাকার। আর দক্ষিণবঙ্গ একেবারে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়েছে, শুধু সুন্দরবনের কারণে।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট “সুন্দরবনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন “ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছিল। সেই গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ রক্ষা করেছিল। এটা তো শুধু একটা ঘূর্ণিঝড়ে যতটা সম্পদ রক্ষা হয়েছে তার হিসাব। এমন প্রতি বছর হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা হচ্ছে সুন্দরবনের কারণে। আর প্রতিনিয়ত সুন্দরবনেরই ক্ষতি করছে এক শ্রেণির মানুষ। সরকারের এ বিষয়ে কঠোর হওয়া উচিত। না হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল কয়েক বছরের মধ্যেই প্লাবিত হবে।

বৃক্ষ কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। এই করোনাকালে মানুষ বুঝেছে অক্সিজেন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেনের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে হাজার হাজার মানুষ। প্রতিদিন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ  পরিবেশ থেকে ৫৫০ লিটার বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করে। বাণিজ্যিকভাবে যার দাম প্রায় চার লাখ টাকা। একটা গাছ বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের বেশি বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে এবং ১০টা এসির সমপরিমাণ তাপ নিযন্ত্রণ করে। গাছ শব্দ দূষণ রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি মানের বনভূমি ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। আর আমরাই গাছ কেটে ফেলি নির্বিচারে। কতটা অকৃতজ্ঞ আমরা! গত কয়েক বছরে সুন্দরবনের গাছ কাটার ফলে আমরা আমাদের বেঁচে থাকার ভরসাস্থল ধ্বংস করেছি।

এভাবে নির্বিচারে সুন্দরবনের গাছ কাটা হচ্ছে, এতে প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের এই গাছ কাটার সঙ্গে যুক্ত থাকার নজিরও আছে। সংবাদমাধ্যমে জেনেছি এই করোনাকালে যখন সুন্দরবনের মধ্যে সাধারণ মানুষের এবং পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ তখন দিনদুপুরে কর্তন নিষিদ্ধ গাছ কেটে বনবিভাগের ট্রলারেই পাচার করা হয়েছে। এতে বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জড়িত। যদি স্থানীয় কেউ এর প্রতিবাদ করে তাহলে তাকে বিভিন্নভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে তো সব শেষ হয়ে যাবে। সরষের ভেতরেই যদি ভূত থাকে, তাহলে সেই সরষে দিয়ে ভূত ছাড়ানো হবে কীভাবে যারা রক্ষা করার তারাই যদি এভাবে গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে আর খুব বেশিদিন দেরি হবে না সুন্দরবন ধ্বংস হতে। বাংলাদেশের দুর্গ হলো সুন্দরবন। সরকারের উচিত এই দুর্গকে বাঁচাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। যেসব সরকারি লোকজন এ কাজে জড়িত থাকবে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা। গাছ কাটা বন্ধে কঠোর আইন এবং তার প্রয়োগ করা।

মোগল সম্রাট জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের কথা অনেকেই জানি। বাবর তার পুত্র হুমায়ুনকে রোগমুক্ত করার জন্য নিজের জীবনের বিনিময়ে হুমায়ুনের জীবন রক্ষার প্রার্থনা করেছিলেন এবং তা-ই হয়েছিল। সন্তানের জন্য পিতার অসীম আত্মত্যাগ। সুন্দরবনও ঠিক পিতার মতো প্রতিটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিজেকে বিপন্ন করে আমাদের দেশকে রক্ষা করে আসছে। তাই যেভাবেই হোক সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় সরকারকে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। গাছ কাটা বন্ধ করে যেকোনো মূল্যে দেশের রক্ষাকবচ সুন্দরবনকে রক্ষা করতেই হবে।

শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়