নিজস্ব প্রতিবেদক: সুপেয় পানির দেশ হলেও পানির অধিকার থেকে আমরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি। বিশ্ব পানি দিবসের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় বক্তারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।
বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা) ও মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিজার সভাপতি প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল।
গোলটেবিলের ধারণাপত্রে প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। পানি-সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা, যেমনÑপানির ঘাটতি, দূষণ, নিরাপদ পানির অধিকার, স্যানিটেশন সমস্যা এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টার গুরুত্ব তুলে ধরতে বিশ্বব্যাপী মানুষ এই দিনটি পালন করে। বিশ্ব পানি দিবস জাতিসংঘের একটি আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান, যার লক্ষ্য পরিবেশের জন্য বিশুদ্ধ পানির গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘শান্তির জন্য পানি’। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বজুড়ে পানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশ্ব পানি দিবসের বার্তায় শান্তির জন্য পানি ব্যবহার এবং আন্তঃসীমান্ত পানি সহযোগিতার জরুরি প্রয়োজনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ২০০ কোটির বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত এবং তাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জনসংখ্যা ২০০ কোটি বৃদ্ধি পাবে এবং বিশ্বব্যাপী পানির চাহিদা ৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে। বর্তমানে বিশ্বে কৃষি খাতের ৭০ শতাংশের বেশিরভাগই সেচ কাজে, শিল্প খাতে ২০ শতাংশ বিশেষ করে জ্বালানি ও উৎপাদনে এবং গৃহস্থালি কাজে ১০ শতাংশ, যার এক শতাংশেরও কম সুপেয় পানি হিসাবে ব্যবহƒত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, নিরাপদ পানির অভাবে হাজারো সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি হয়ে থাকে। মানবশরীরের কিডনি, লিভার, হার্টসহ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে। নিরাপদ পানির অভাবে ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষ পেটের সমস্যাসহ নানা সমস্যায় ভুগে থাকেন।
অধ্যক্ষ আকমল হোসেন বলেন, আমাদের জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়েছে পানির নিরাপদ আধারগুলো না থাকার কারণে। আমাদের গ্রাম ও শহরে কৃষি ও প্রতিবেশ বিনষ্ট হয়েছে পানি সংকটের কারণে। নদীগুলোয় যে পানিপ্রবাহ নেই, তার কারণ আন্তঃদেশীয় পানির হিস্যা না পাওয়া।
পরিজার সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, ঢাকা শহরের লাখ লাখ প্রান্তিক মানুষ পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। সকালবেলায় বস্তির মানুষেরা এক কলসি পানির জন্য এই শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে, যা তাদের জীবন-জীবিকাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলছে। সরকারকে এই প্রান্তিক মানুষের কথা ভেবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের সদস্য সচিব মাহবুল হক বলেন, পানি জনগণের অধিকার ও মানবাধিকার। এই অধিকারকে বাস্তবায়ন করার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। একটি রোডম্যাপ করে দেশব্যাপী পানির অধিকারের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বস্তিবাসী নেত্রী হোসনে আরা বেগম রাফেজা বলেন, আমরা বস্তিবাসীরা পানি পাই না আর পানির অপচয় দেখি সর্বত্র। বস্তির মানুষ সবচেয়ে বেশি পানির টাকা প্রদান করে, কিন্তু তাদের সবচেয়ে করুণ জীবনযাপন করতে হয় পানির অভাবে।
ক্যামেলিয়া চৌধুরী বলেন, আমরা চাই একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের পানির চাহিদা পূরণ করা হোক। তিনি সরকারকে আরও সচেতন হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
গোলটেবিলে আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন, লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, পরিজার সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের সদস্য সচিব মাহবুল হক, পরিজার সহসভাপতি ক্যামেলিয়া চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হাসান মাসুদ, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট তানইয়া নাহার, মো. সেলিম, হোসনে আরা বেগম রাফেজা, মো. ইব্রাহিম, সীমান্ত সিরাজ প্রমুখ।
বুড়িগঙ্গা দূষণ ও পানির গুণাগুণ পরীক্ষার ফলাফল
গোলটেবিল বৈঠকে বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে গত ১৭ ও ২০ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ পর্যবেক্ষণ এবং ২০ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে তার প্রতিবেদন তুলে ধরেছে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা)। সেখানে দেখা যায়, সদরঘাট টার্মিনাল (১৩ নম্বর পন্টুন) থেকে শ্যামপুর বিআইডব্লিউটিএ টার্মিনাল পর্যন্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) ০.১৪-০.৭২ মিলিগ্রাম/লিটার এবং পিএইচ ৬.৭৯-৭.২৭। এ অবস্থায় নদীতে কোনো জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) ৪ মিলিগ্রাম/লিটার থাকা প্রয়োজন। অপরিশোধিত শিল্পকারখানায় বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) ০.১৪-০.৭২ মিলিগ্রাম/লিটার।
গোলটেবিল বৈঠকে করা সুপারিশ
১. ড্রেজিং করে নদীর নাব্য বৃদ্ধি করা এবং অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ২. অপরিশোধিত শিল্পকারখানায় বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করা; ৩. ঢাকার আশেপাশের নদীসহ অন্য সব নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, লেক, দিঘি-পুকুর, নিম্নাঞ্চল, জলাভূমি দখল, ভরাট ও দূষণ বন্ধে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ৪. নদী দূষণমুক্ত করা। নদীর পানি কৃষি ও শিল্পে এবং পরিশোধন করে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা; ৫. খরা মৌসুমে সেচ ও রাসায়নিক সারনির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে প্রকৃতিনির্ভর ধান চাষ করা। প্রকৃতিনির্ভর ধান চাষে গবেষণা জোরদার করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা; ৬. নদীর প্রবাহ ও নাব্য যথাযথ রাখার লক্ষ্যে নদীতে পিলারসমৃদ্ধ ব্রিজের পরিবর্তে ঝুলন্ত ব্রিজ বা টানেল নির্মাণ করা; ৭. নিরাপদ পানি নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা; ৮. শিল্পকারখানায় ব্যবহƒত পানি পুনর্ব্যবহার করা; ৯. ভূগর্ভে কৃত্রিম রিচার্জ করা, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায়; ১০. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রাপ্য ন্যায্য সম্পদ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের আরও অধিকতর টেকসই জীবনযাত্রার প্রতি গুরুত্বারোপ করা।