আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: বিশ্বের চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগই পানি। তবুও বিশ্বে সুপেয় পানির সংকট চলছেই। তাই পানির গুরুত্ব অনুধাবন করেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও শহরে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি বছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয় এবং এরপর থেকে এ দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে। অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সুপেয় পানির সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) কর্তৃপক্ষকে সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আমাদের ওয়াটারকিপার হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)। ওয়াসা এবং ডিপিএইচই স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং নারায়ণগঞ্জের পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য দায়িত্ব ওয়াসার ওপর ন্যস্ত। একই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ওয়াসার আওতাধীন এলাকা ব্যতীত সমগ্র দেশের নিরাপদ পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে অর্পণ করা হয়েছে।
নিরাপদ পানি সরবরাহের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের দায়িত্ব অর্পণ করে ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর সরকার প্রথমেই ধ্বংসপ্রাপ্ত পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন পদ্ধতিগুলোর পুনর্বাসনের গুরুত্বারোপ এবং তৎপরবর্তীতে ডিপিএইচই’র মাধ্যমে নতুন অবকাঠামো স্থাপন শুরু করে। একই ধারাবাহিকতায় মহানগর এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৯৬ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা ওয়াসার আওতাধীন এবং ওই এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ওয়াসা কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করা হয়। সংস্থা দুটির আওতাধীন এলাকায় অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সুপেয় পানি সরবরাহ, বিপণন করতে পারবে না।
দ্রুত নগরায়ণের ফলে শহর ও মহানগর এলাকায় পানি চাহিদা ও সরবরাহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সঙ্গে বাংলাদেশেও সুপেয় পানির জন্য হাহাকার বাড়ছে। জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ ও সুপেয় পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ছাত্রজীবনে পড়ে এসেছি ‘ভ্যালুয়িং টাইম’ কিন্তু ২০২১ সালে বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছিলÑ‘ভ্যালুয়িং ওয়াটার’। এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণের কারণ পাইপের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী পানি পান, যা বিশ্বব্যাংক এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য এক সমীক্ষায় ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশের মাত্র ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ পুরোপুরি নিরাপদ পানি পাচ্ছে। এ হিসেবে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনও সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাগুলোতে সুপেয় পানি যেন এক সোনার হরিণ। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চল এবং পাহাড়ি এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। তারপরও ঢাকা ওয়াসা বিগত ১৪ বছরে ১৫ বার পানির দাম বাড়ায়। অথচ নিরবচ্ছিন্নভাবে সুপেয় পানি সরবরাহ করছে না, এটি দুঃখজনক। সম্প্র্রতি প্রতিষ্ঠানটি পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যা আগামী ১ সেপ্টেম্বর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
তাছাড়া ওয়াসার পানি ফুটাতে প্রতি বছর অযুক্তিক কারণে ৫৮ কোটি টাকা মূল্যের গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে; যা বিশাল বড় অপচয়ও বটে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তথ্যমতে, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করেছে ৩২ টাকা। এই হিসেবে রাজধানীবাসী গড়ে প্রতিদিন যদি আধা ঘণ্টা করে পানি ফুটায়, তবে গড়ে দিনে তারা প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ঘনমিটার গ্যাস পোড়ায়। এ গবেষণায় দেখা যায়, গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতি বছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়। ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ হলে এ অপচয় হতো না।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৩ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় সব বয়সী সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ এবং ৬ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিতকরণের কথা বলা হয়েছে। তাই ওয়াসা এবং ডিপিএইচই জনগণের কাছে নিরাপদ পানি সুবিধা পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহ করে মানুষের চাহিদা পূরণ করতে কতটা সফল হয়েছে, তা বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ ও প্রতিবেদন থেকে সবাই অবগত আছেন। নিরাপদ ও সুপেয় পানির জন্য প্রায়ই হাহাকার দেখা যায়, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। এরই ফলে বাংলাদেশের মুনাফাখোর ও লুটেরা বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানা কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনকে অবজ্ঞা করে সক্রিয় সংঘবদ্ধ চক্র প্লাস্টিকজাত বোতল করে পানি বিক্রয় শুরু করেছে। বিনা মূল্যে প্রাপ্ত পানি বোতলজাত করে তাদের ইচ্ছামতো অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক দাম হাঁকিয়ে ভোক্তা-ক্রেতা সাধারণের কষ্টার্জিত আয় লুটে নিচ্ছে। ওই অর্থ সিন্ডিকেট লুটে খায় কিন্তু নাগরিকরা অসহায়, যা আইন পরিপন্থিও বটে।
আইনকে উপেক্ষা করার প্রবণতা থেকেই লুণ্ঠন, অবৈধ পানি বিক্রয় ও বিপণন লাগামহীনভাবে অনেক দিন ধরে চলছে। লোভ বাড়তে বাড়তে ভোগের উৎসব শুরু হয়েছে, এতেই বোঝা যাচ্ছে প্রচলিত আইন সুপেয় পানির অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ। এই অপরাধকে লুট বা দখলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পানি বোলতজাত করে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এসব ব্যক্তিমালিকানাধীন সিন্ডিকেট ধ্বংস করতে হবে। বোতলজাত পানি বিক্রয় ও বিপণন বন্ধে স্থায়ী তদারকি ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। ওয়াসা এবং ডিপিএইচই উভয় কর্তৃপক্ষকে সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণ আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com