Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:57 pm

সুপেয় পানি সংগ্রহে দীর্ঘ লাইন, তিন দিন খাবার নেই

প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ জনপদ। এ আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষ একদিকে প্রচণ্ড খাদ্যের সংকটে পড়েছেন, অন্যদিকে এলাকায় নেই কোনো সুপেয় পানি।

সরেজমিনে আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টায় সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার দয়ারঘাট গ্রামের অসহায় নারী ও কিশোরীদের দীর্ঘ লাইনে দেখা গেল পানি সংগ্রহ করতে। পরিবারের জন্য এক কলসি খাবার পানি সংগ্রহ করতে তারা সারা শরীরে ভিজা কাপড়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সকাল ৬টা থেকে।

রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল আন্না মণ্ডলের সঙ্গে। আশাশুনি উপজেলার দয়ারঘাট গ্রামের রবীন্দ্র মণ্ডলের স্ত্রী তিনি। বছর তিরিশের গৃহবধূ। দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে পড়েছেন মহা বিপাকে। বুধবার রাতে দীর্ঘসময় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে তার বসতবাড়ি ভেঙে পড়ে গেছে। বাড়ির মধ্যে কোনো শুকনা জায়গা নেই।

পাশের খোলপেটুয়া নদীর দয়ারঘাট পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে তাদের গ্রামের (দয়ারঘাট) সব স্থানে নদীর পানি ঢুকে গেছে। ওই গ্রামের সব বসতবাড়ি তিন-চার ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। সে সময় কোথাও আশ্রয় নেওয়ার জায়গা থাকে না।

ওই সময় ভিজা কাপড়ে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার ভাটার সময় পানি কিছুটা কমে যায়। এত কষ্ট করে তারা এলাকায় থাকছেন। বিগত তিন দিনে তার কাছে কেউ কোনো খাবার পৌঁছে দেয়নি। প্রায় সবাই না খেয়েই আছেন। তবে সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে খাবার পানির। আন্না মণ্ডল জানালেন, সকাল ৬টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন এক কলসি পানির জন্য।

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শুকতারা মণ্ডল। সারা শরীরে ভিজা কাপড়। একটি কলসি পানি কোমরে আটকে সে পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অল্প সময় আলাপ হলো তার সঙ্গে। জানাল, প্রতিদিন এভাবে ভিজে ভিজে পানি সাঁতরে ডাঙায় উঠে উপজেলা সদর থেকে এক কলসি খাবার পানি নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়।

সেই পানি বাড়ির সবাই অল্প পরিমাণে খেয়ে কোনো রকমে গলা ভিজিয়ে রাখে। পরের দিন পানি ঘরে আনতে পারলে তবেই স্বস্তি পাওয়া যায়। কারণ নদীর জোয়ারের পানিতে গোটা গ্রাম প্লাবিত হলেও সেই পানি পান করা যায় না, কারণ তা লোনা। আজ সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থেকে এক কলসি পানি নিতে পেরেছে।

গৃহবধূ ডলি সানা, মালতী দাস, শান্তি দাস, মিনতি বালা ও কলেজছাত্রী আরতী গাইন জানালেন, তারা সকাল ৬টা থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক সরবরাহ করা পানি সংগ্রহের জন্য। সবাই একটি করে কলসি দিয়ে লাইনে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে রেখেছেন। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানালেন, বিগত তিন দিন তারা একপ্রকার পানি না খেয়ে আছেন।

একদিকে খাবারের কষ্ট, অন্যদিকে পানির কষ্ট। বাড়িতে রান্না করার মতো কোনো শুকনা জায়গা নেই। অনেকের বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস ও মুরগি মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তারা গবাদিপশুকে খেতে দিতে পারছেন না। আবার এসব পশু-পাখিকে ডাঙায় নিয়ে আসতেও পারছেন না।

তাদের একদিকে এক কলসি খাবার পানি সংগ্রহ করার জন্য দিনের বড় সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে অবস্থান করার মতো পরিস্থিতিও নেই। ঘরে নেই খাবার।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের উদ্যোগে জারে করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে তা অপ্রতুল। ঘটনাস্থলে ব্র্যাকের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন জানালেন, তারা আগামী কয়েক দিন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মানুষের মাঝে নিরাপদ খাবার পানি বিতরণ করবেন।

আশাশুনি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা তানজির হোসেন জানালেন, তারা তিনটি জাপানি অত্যাধুনিক মেশিন দিয়ে স্থানীয় পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে সঙ্গে সঙ্গে রিফাইন করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সুপেয় পানি বিতরণ করছেন। আগামী কয়েক দিন তারা এভাবে সুপেয় পানি সরবরাহ কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।

আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম কুমার চক্রবর্তী জানান, জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ পাওয়ায় অতি দ্রুত দয়ারঘাট বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হবে। এছাড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসনে বরাদ্দ পাওয়া গেছে। দ্রুততার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যোগে উপজেলার তিন পয়েন্টে গাড়িতে করে খাবার পানি বিতরণ কর্মসূচি আজ থেকে চালু হয়েছে। পানি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।