সুবর্ণজয়ন্তীতে আমার স্বাধীনতা

কাজী সালমা সুলতানা: ২৩ মার্চ, ১৯৭১ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। এদিন পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে জয় বাংলা বাহিনী আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যায়।

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সাবেক বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে গঠিত ‘জয় বাংলা বাহিনী’র আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মহড়া আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। জয় বাংলা বাহিনীকে চারটি প্লাটুনে ভাগ করে চারজন প্লাটুন কমান্ডারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেদিন জয় বাংলা বাহিনী অভিবাদন গ্রহণ করেন আ স ম আবদুর রব, আবদুস কুদ্দুস মাখন, নুর এ আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, কামালউদ্দীন (পরে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অফিসার) ও মনিরুল হক (ঢাকা শহর ছাত্রলীগ সভাপতি)। পতাকা উত্তোলনের সময় কামরুল আলম খান খসরু এমএম-৭ রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলি করা হয়। খসরুর পাশে হাসানুল হক ইনু পতাকাটি হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। এ সময় রেকর্ডে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাজানো হয়।

এখান থেকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা শেখ মুজিবের বাড়িতে যান। সেখানে তারা সামরিক কায়দায় সালাম দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ শেষে জয় বাংলা বাহিনীর উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই আপনারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবেন। বাংলার জয় অনিবার্য।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তার বাসায় ও গাড়িতে দুটি পতাকা ওড়ানো হয়।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি প্রমুখ। তখন ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি গাওয়া হয়। এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীন বাংলার পতাকা বিতরণ করা হয়। এ পতাকাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার অনুমোদন করে।

পাকিস্তান দিবসে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজকের দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সে অনুযায়ী আজ তিনি গোটা বাংলায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।

এদিন ঢাকায় সেক্রেটারিয়েট ভবন, হাইকোর্ট ভবন, পরিষদ ভবন, ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বেতার কেন্দ্র, ঢাকা টেলিভিশন ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিফোন ভবন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, প্রধান বিচারপতি ও মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাধা দেয়। কিন্তু ছাত্র-জনতা সে বাধা উপেক্ষা করে পতাকা উত্তোলন করে।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে। এ উপলক্ষে রাজধানীতে গণ-আন্দোলন গণজোয়ারে পরিণত হয়।

এদিন রাজপথে লাঠি, বর্শা ও বন্দুকের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে সারাদিন রাজধানীকে প্রকম্পিত করে রাখে। মিছিলে ভুট্টো ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়। জনতা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলি ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করে।

আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বিচারপতি এআর কনেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা, এমএ আহমেদ, কর্নেল হাসানের সঙ্গে দুপুরে ও বিকালে দুই দফায় দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক করেন।

বিকালে পশ্চিম পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে কাউন্সিল মুসলিম লীগপ্রধান, জমিয়তে ওলামায়ে প্রধান, পাঞ্জাব কাউন্সিলপ্রধান ও বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাই দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়ে যাক।’ এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা ভালো কামনা করুন, কিন্তু খারাপের জন্যও প্রস্তুত থাকুন।’

বিকালে রংপুরের সৈয়দপুর সেনাবাহিনী ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হন। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী জোর করে সৈয়দপুর শহরের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে কারফিউ জারি করে। এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সেনানিবাসে গিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি সৈনিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন।

তথ্য সূত্র : মূলধারা ৭১ ও বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০