Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 9:19 am

সুমি’স হট কেক’র সাড়ে দশ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিখ্যাত কেক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সুমিস হট কেক। উত্তরার এই প্রতিষ্ঠানটির সাড়ে ১০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন ও মামলা করেছে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। বিক্রয় তথ্য গোপন ও মেশিনে প্রস্তুতকৃত কেক হাতে তৈরির ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুন) এই মামলা করা হয়। ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ২ জুন উপ-পরিচালক নাজমুন নাহার কায়সার ও ফেরদৌসী মাহবুব এর নেতৃত্বে ভ্যাট গোয়েন্দার একটি দল সুমিস হট কেক লিমিটেড (আহালিয়া, তুরাগ, প্লট-২০, রোড-১, লেন-০৪, ওয়ার্ড-৭, ব্রক-এ, ঢাকায) এর কারখানা কাম প্রধান কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে কেন্দ্রীয়ভাবে নিবন্ধিত। রাজধানীসহ  সারাদেশে এই কেক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ২৬টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এসব বিক্রয়কেন্দ্রে কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করা হয়।

অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি হাতে তৈরির কেক ঘোষণা দিলেও মূলত মেশিনে কেক প্রস্তুত করে আসছে। মেশিনে তৈরির কেক এর উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। কিন্তু হাতে তৈরি করলে তা ৫ শতাংশ। এতদিন সুমিস কেক ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়েছে। ভ্যাট গোয়েন্দার পরিদর্শনকালে ভ্যাট সংক্রান্ত নথিপত্র দেখাতে বলা হলে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহযোগিতা করেন। পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়ের তথ্যসহ আরো কিছু বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।

সুমিস হট কেক এর ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি তিন ধরনের ভ্যাট হার বিশিষ্ট পণ্য সরবরাহ মূল্য তাদের রির্টার্নে উল্লেখ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে আদর্শ হারে পণ্য (মূসক ১৫ শতাংশ), সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্য (সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ), আদর্শ হার ব্যতীত অন্যান্য হারে পণ্য (মূসক ৫ শতাংশ) ও অব্যাহতি প্রাপ্ত পণ্য। তবে রিটার্নের সংযুক্ত সাব-ফরম যাচাই করে দেখা যায়, মেশিনে প্রস্তুতকৃত কেক ও অন্যান্য কেক এর মূল্য রিটার্নের নোট-৭ এ উল্লেখ করে এবং এর উপর ৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে এই পণ্যের উপর আদর্শ হারে ভ্যাট (মূসক ১৫ শতাংশ) প্রযোজ্য হবে। কারণ সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির সকল ধরনের কেক মেশিনে প্রস্তুত করা হচ্ছে। পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানের কারখানায় স্থাপনকৃত কেক মিক্সিং মেশিন ছয়টি, অটো ওভেন (ক্যাপাসিটি ১০৫টি) দুইটি, বিস্কুট প্রস্তুতের বড় অটো ওভেন একটি, ক্রিম মিক্সিং মেশিন একটি দেখতে পাওয়া যায়। কেক তৈরিতে এসব মেশিন ব্যবহার হচ্ছে।

পরিদর্শনকালে কেক প্রস্তুতের সিনিয়র সেফ এর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের কারখানায় কয়েকটি ধাপে কেক প্রস্তুত করা হয়। এরমধ্যে মিক্সিং মেশিনে ডিমের ফোম প্রস্তুত করা; ডিমের ফোমের সাথে অন্যান্য উপকরণ দিয়ে মিক্সিং মেশিনে ৩০ মিনিট মিশিয়ে কেক এর বেটার প্রস্তুত করা; কেক বেটার ডাইসে ঢেলে অটোমেটিক ওভেনে ৩০ মিনিট রেখে বেক করা; ডেকোরেশনের জন্য মিক্সিং মেশিনে ক্রিম প্রস্তুত করা; ওভেনে বেক করা কেকের উপর ক্রিম দিয়ে ডিজাইন করা এবং সরবরাহের জন্য তা বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।

প্রতিষ্ঠানের কারখানায় কেক প্রস্তুতের জন্য কিছু কাজ হাতে (যেমন-বস্তা থেকে ময়দাসহ অন্যান্য উপকরণ মিক্সিং মেশিনে ঢেলে দেয়া, কেক এর বেটার মিক্সিং মেশিন থেকে নামানো, ক্রিম দিয়ে ডিজাইন ইত্যাদি) করা হলেও কেক প্রস্তুতের মূল কাজ মেশিনে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি কেক তৈরির মূল প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধরনের মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেও হাতে তৈরি কেক এর হার অনুযায়ী ভ্যাট প্রদান করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছিল।

মামলার প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কেক মেশিনে প্রস্তুত বিবেচনায় নিয়ে তার উপর আদর্শহারে ভ্যাট আদায়যোগ্য। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য কেক প্রস্তুতকারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়ে আসছে। সুমিস হট কেক কম ভ্যাট দেয়ায় অন্যান্য প্রস্তুতকারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়েছে।

প্রতিষ্ঠানের ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দাখিলপত্র অনুযায়ী, মেশিনে প্রস্তুত কেক এর সরবরাহ মূল্য ২৬ কোটি ৯০ লাখ ৭২৬ টাকা। এই কেকসমূহ মেশিনে প্রস্তুত করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি (হাতে তৈরি কেক হিসেবে ৫ শতাংশ হারে) ভ্যাট প্রদান করে এক কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির জন্য প্রযোজ্য আদর্শ হার হলো ১৫ শতাংশ। ফলে ৪ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজার ১০৯ টাকা ভ্যাট প্রযোজ্য। সে বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট এর পরিমাণ ২ কোটি ৬৯ লাখ ৭৩ টাকা। এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সুদ ৬০ লাখ ২২ হাজার ৬৬৯ টাকা প্রযোজ্য।

এছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দকৃত সিএ রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ২০১৬ সালের জুলাই হতে ২০১৯ সালের পর্যন্ত সময়ে প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ৫৫ কোটি ৫৫ লাখ ১২ হাজার ৮৬৫ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য ২৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৬১ টাকা প্রদর্শন করেছে। এর মাধ্যমে সুমিস কেক ২৯ কোটি ৬৯ লাখ ৪১ হাজার ৪ টাকা বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করেছে। কম পরিশোধিত বিক্রয়মূল্যের উপর ১৫ শতাংশ হিসেবে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৯৩০ টাকা ভ্যাট প্রযোজ্য। এই সময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ৩ কোটি ৮৯ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৯ টাকা ভ্যাট প্রদান করেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের পরিহারকৃত ভ্যাট এর পরিমাণ ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭১ টাকা। এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সুদ বর্তায় ২ কোটি ৭৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৬ টাকা।

প্রতিবেদন অনুসারে, সুমিস হট কেক ২০১৬ সালের জুলাই হতে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৭ কোটি ১৩ লাখ ১৪৩ টাকা ভ্যাট পরিহার করেছে এবং এই পরিহারকৃত ভ্যাট এর উপর সুদ বাবদ ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার ৭৬৫ টাকাসহ সর্বমোট ১০ কোটি ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৯ টাকা আদায়যোগ্য হবে। তদন্তে উদ্ঘাটিত ভ্যাট ফাঁকির টাকা আদায়ের আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মামলাটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে প্রেরণ করা হবে। একইসঙ্গে এখন থেকে যথা নিয়ম ও হারে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ভ্যাট কার্যালয়কে সুপারিশ করা হবে বলে জানান ড. মইনুল খান।

###