ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সুবিধা

সুযোগ নিতে চট্টগ্রামের বড় খেলাপিদের আগ্রহ কম

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নানা কারণে ব্যবসায় মন্দার পাশাপাশি স্বেচ্ছা খেলাপিও অনেক। তাই প্রকৃত খেলাপিদের সুযোগ দিতে বাংলাদেশ একটি বিশেষ নীতিমালা জারি করে। এর আওতায় ঋণ পুনঃতফসিল ও এক্সিট সুবিধা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়। চট্টগ্রামের শতাধিক বড় ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান আছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন, স্থানীয় বাজারে অসম প্রতিযোগিতা, উদ্যোক্তার দূরদর্শিতার অভাবে লোকসানে পড়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ট্রেডিং খাত; অর্থাৎ ভোগ্যপণ্য (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি) আমদানিকারক, জাহাজ ভাঙা, জাহাজ নির্মাণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ফলে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি হয়ে পড়েন এসব খাতের ব্যবসায়ী। এ কারণে গত এক দশক ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে হয় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের। তবে ঋণ পুনঃতফসিলে তাদের আগ্রহ কম।
তথ্যমতে, গত ১৬ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে। এ নীতিমালার আওতায় স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দ মানের খেলাপিরা ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সুবিধা পাবেন।
নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপিরা দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল সুবিধা পাবেন। কেস টু কেস বিবেচনায় ঋণ পরিশোধে এক বছরের জন্য গ্রেস পিরিয়ডও পাওয়া যাবে। অর্থাৎ প্রথম এক বছরে খেলাপিদের ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। মওকুফ হবে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ ও ইন্টারেস্ট সাসপেন্সেস হিসেবে রক্ষিত সুদও।
জারি করা নীতিমালার আওতায় ট্রেডিং (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি), জাহাজশিল্প, লোহা ও ইস্পাতশিল্প খাতের খেলাপিরা সরাসরি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। অন্য খাতের ঋণখেলাপিদের পুনঃতফসিল সুবিধা পেতে ব্যাংকের বিশেষ নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। যেসব ঋণখেলাপি বিশেষ সুবিধা নিতে চান, আগামী ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের আবেদন করতে হবে। কিন্তু চট্টগ্রামের অধিকাংশ বড় ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান এখনও ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন করেননি। যদিও ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক, জাহাজ ভাঙা, জাহাজ নির্মাণ শিল্প খাতের চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
ব্যাংকগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামে এসব খাতের শতাধিক বড় খেলাপি প্রতিষ্ঠান আছে। এছাড়া মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠান আছে আরও দেড়শর মতো। কিন্তু অধিকাংশ বড় ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেনি। এর মধ্যে গ্রুপ হিসেবে নুরজাহান, রাইজিং, মোস্তফা, সিলভিয়া, এমইবি, ইমাম, এসএ, ক্রিস্টাল, মাবিয়া, মেরিন, বনলতা, সানোয়ারা গ্রুপ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নুরজাহান, মোস্তফা, সাদ মুসা, হাবিব, এমএইচ, বাদশা, এসএ গ্রুপের এক-দুটি প্রতিষ্ঠান আট-নয়টি ব্যাংকের শাখায় আবেদন করেছে। তবে যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ আছে, সেসব ব্যাংকে একসঙ্গে আবেদন করেনি। এছাড়া একক ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিদ্দিক ট্রেডার্স, লিজেন্ড হোল্ডিংস, ছগির অ্যান্ড ব্রাদার্স, তানিয়া এন্টারপ্রাইজ, আহাদ ট্রেডিং ও জালাল অ্যান্ড সন্স, শাহেদ শিপ ব্রেকিং লিমিটেড, আকতার এন্টারপ্রাইজ, পেনিনসুলা স্টিল, ফরচুন স্টিল, শফিক স্টিল, সুপার সিক্স স্টিল, শাহ আমানত আয়রন, এ মেরিন টেকনিক্যাল সার্ভিসেস, সুলতানা শিপ ব্রেকিং লিমিটেড, জাহিদ এন্টারপ্রাইজ, টেকনো বিল্ডার্স, সি টেক্স, বেনজা স্টিল, এসকে শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড স্টিল লিমিটেড, মার্ক শিপ ব্রেকিং, মাস্টার্ড ট্রেডিং, এ জামান অ্যান্ড ব্রাদার্স, রুবিয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, চিটাগং ইস্পাত লিমিটেড, ইয়াসির এন্টারপ্রাইজসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান এখনও পর্যন্ত আবেদন করেনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেন, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য কারণে ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মিত হয়ে গড়ে। এ সংকট থেকে উত্তরণে এ সুবিধা একটি ভালো উদ্যোগ। তবে ব্যাংকগুলো ব্যবসা পরিচালনায় নতুনভাবে অর্থায়ন করবে না। এটা নিয়ে চিন্তায় আছি। কারণ, টাকা থাকলে তো আমরা ব্যবসা চালিয়ে যেতাম এবং ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতাম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নীতিনির্ধারকদের আরও চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। না হলে এ উদ্যোগে সফলতা আসবে না।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট এএসএম হেলাল উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করেছে; তার আওতায় বড় ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও পর্যন্ত আবেদনে আসেনি। আগামী ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আবেদন করতে হবে। কিন্তু সময় শেষ হয়ে এলেও তাদের আগ্রহ নেই। আর যে দু-তিনটি আবেদন এসেছে, তা সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়। অথচ আগে খেলাপি ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে আসতেন খেলাপি ঋণ রিশিডিউলড করার জন্য।
একই বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের বাংলাদেশ লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মিয়া মোহাম্মদ বারাকাত উল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা নেওয়ার জন্য এখনও পর্যন্ত বড় খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদন করেনি। এ বিষয়ে কয়েকজন বড় গ্রাহকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হলেও অগ্রগতি নেই। আর ব্যাংকার হিসেবে গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছি। বাকিটা তাদের বিষয়। এক্ষেত্রে আইন অনুসারে কার্যক্রম চলবে।
এ বিষয়ে নুরজাহান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহম্মদ রতন শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সার্কুলার আবারও আমাদের ব্যবসায় ফিরে আসার একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে আমরা কয়েকটি ব্যাংকে পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করেছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমি ইচ্ছা করে খেলাপি হইনি। আমার কোনো খারাপ মোটিভ ছিল না। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক দরপতনের কারণে সে সময়ে আমি ব্যবসায় লোকসান করি। ফলে নিয়মিত পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
অপরদিকে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, অনেক দেনদরবার করে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়েছি। কিন্তু ব্যাংকগুলো পুনঃঅর্থায়ন করছে না। এতে কারখানা সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। এভাবে হলে তো শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। তাই নতুনভাবে কারখানা পরিচালনার জন্য ঋণ দিতে হবে। কারণ, শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেই ব্যাংকের দায় শোধ করতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০