খন্দকার রাহাত মাহমুদ : তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফের দূরত্ব কত হতে পারে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে, এই দূরত্ব আর হাতে হাতে ফিতা বা চেইন দিয়ে মাপার প্রয়োজন পড়ে না। গুগল ম্যাপ বলছে, ৯৩৪ কিলোমিটার। গুগল কর্তৃপক্ষ যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, দূরত্ব পরিমাপ করার জন্য, সেখানে হয়তা ভুলের সম্ভাবনা কম। তবে, এই দূরত্বেও তারতম্য হতে পারে, পথ ভেদে। বিশ্বখ্যাত গুগল যে পথে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্ব ৯৩৪ কিলোমিটার দেখাচ্ছে, অন্য পথে হয়তো তার চেয়ে বেশিও হতে পারে আবার কমও হতে পারে। এটা পুরোটাই নির্ভর করছে, আপনি যে পথে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ যাত্রা শুরু করেছেন, সেই পথের ওপর। দূরত্ব যাই হোক, আর পথই বা যেটাই হোক, আপনি যখন তেঁতুলিয়া থেকে রওনা দিয়েছেন, তখন যে যানবাহনে করে আপনি যাচ্ছেন, তাতে বসে আপনার দুই নয়ন হয়তো আনন্দে ভরে উঠছে, চার পাশের ঘন সবুজের ক্ষেত দেখে। বাংলার কৃষক এই নয়নাভিরাম ক্ষেতের কারিগর।
ফসল উৎপাদনের জন্য এই কৃষকের কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ডিগ্রি নেয়া নেই। এদের প্রশিক্ষণ বলতেও তেমন কিছুই নেই। মানুষ যেমন জšে§র পর থেকে আস্তে আস্তে কথা বলতে শেখে, ভাব-ভঙ্গিমা প্রকাশ করতে শেখে, ঠিক তেমনি এরা জš§গতভাবেই ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া শিখেছেন। ঠিক কখন, ফসলের কি ধরনের পরিচর্যা করতে হবে, তা তারা অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।
ফসল উৎপাদনের যেসব উপকরণ তাদের লাগে, তা তারা লাঙল, জোয়াল, মই, পাচুন প্রভৃতি নামেই চেনেন, উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে চেনেন না বা তাদের কেউ বলেননি যে, এগুলো লাঙল, জোয়াল, মই নামের চেয়ে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে অধিক ভূমিকা বা গুরুত্ব বহন করে থাকে। অবশ্য বর্তমানে, লাঙল জোয়ালের পরিবর্তে প্রযুক্তির উন্নয়নে ট্রাক্টর নামক যন্ত্রের সঙ্গে কৃষকের হƒদ্যতা বেড়ে গেছে। আগে চাষের গরুকে যে পরিমাণ যতœআত্তি করতে হতো, সেই পরিমাণ মায়া এখন যন্ত্রের সঙ্গে কৃষকের গড়ে উঠছে এবং ভবিষ্যতে আরও গড়ে উঠবে। ফসল উৎপাদনে তেঁতুলিয়ার কৃষক যে পরিমাণ সার ব্যবহার করছেন, রাজধানী ঢাকার আশপাশের কৃষকও উৎপাদনের জন্য সেই পরিমাণ সারই হয়তো ব্যবহার করছেন। পরিবেশ আর ব্যবহার ভিত্তিতে সামান্য তারতম্য হতে পারে। তেঁতুলিয়ার কৃষকের ফসল উৎপাদনে যে কয়দিন যায়, যে পরিমাণ শ্রম দিতে হয়, ঢাকার সাভার বা মানিকগঞ্জের কৃষককেও সে পরিমাণ সময়ই ব্যয় করতে হয়। উৎপাদন পর্যায়ে উন্নত এলাকার কৃষকের আর অনুন্নত এলাকার কৃষকের শ্রমের মূল্যেও তেমন কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। কিন্তু, সমস্যাটা বেঁধে যায়, বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে। রাজধানীর বাজারে এক কেজি বেগুনের দাম যদি আশি টাকা হয়, দেখা যাবে তেঁতুলিয়ায় যদি সেই বেগুন উৎপন্ন হয়ে থাকে, তবে উৎপাদনের এলাকায় বা তেঁতুলিয়ায় এক কেজি বেগুনের দাম অর্ধেকেও কম। কৃষক সরাসরি আশি টাকা বা তার কাছাকাছি অর্থ পেলে তিনি যতটুকু উৎসাহবোধ করতেন, চল্লিশ টাকা দরে বিক্রি করায় তিনি সে উৎসাহ পাচ্ছেন না। বরং একটা কিছু করে খেতে হবে, তাই তিনি বাবার রেখে যাওয়া জমিতে বেগুন চাষ করছেন। মাঝখানে এই যে বৈষম্য তৈরি হলো, তা টেকসই উন্নয়নের জন্য বড় বাধা হয়ে থাকল। সুষম উন্নয়নের জন্য বৈষম্য কমাতে হবে। সুষম উন্নয়ন না হলে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। শিল্প-কলকারখানার বিকেন্দ্রীকরণ, সুষম উন্নয়নের একটি বড় হাতিয়ার হতে পারে। তাবৎ শিল্প কারখানা ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ আর গাজীপুরে কেন্দ্রীভূত না করে, যদি দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপন করা যায়, তাহলে ওই এলাকা স্থানীয়ভাবে অর্থনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। একটা বড় শিল্প কারখানাকে ঘিরে ছোট ছোট আরও শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠে। সেখানে নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। নতুন শিল্পের পাশাপাশি, অর্থনীতির, সমাজনীতির, সংস্কৃতির পরিবর্তন হতে থাকে। শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে, শ্রমের অভিবাসন কমে যায়। ফলে, শ্রম বাজারের যে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, তা বজায় থাকে। দেশের উত্তরে বড় কোনো শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠলে, সেখানকার শ্রমিককে তার শ্রম বিক্রি করার জন্য ঢাকায় বা দক্ষিণে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। বাড়ির কাছে শ্রম বিক্রির সুবিধা থাকায় শ্রমিক দিন শেষে তার পরিবারকে সময় দিতে পারবেন। ফলে, পারিবারিক তথা সামাজিক স্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে। দেখা যায়, রাজধানীর আশপাশে এবং রাজধানী থেকে দূরে অবস্থানরত কৃষকের উৎপাদন খরচ প্রায় একই হয়। রাজধানী থেকে দূরে অবস্থিত কৃষকের উৎপাদিত পণ্য, ভোক্তা বাজারে আসতে পরিবহন খরচ, মধ্যস্বত্বভোগীর মুনাফা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে নায্য মূল্যে বিক্রি হয় না।
উৎপাদনের উপকরণ এবং উৎপাদন খরচ একই হওয়া সত্ত্বেও উত্তর-দক্ষিণ কিংবা পূর্ব-পশ্চিমের উৎপাদক তথা কৃষকরা একই পণ্য থেকে সমমূল্য পাচ্ছেন না। পণ্য মূল্যের তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের চেয়ে উৎপাদিত পণ্যে উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা কম মূল্য পাচ্ছেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এলাকাভিত্তিক প্রাধান্য পাওয়ায় এবং ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কারণে এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চল থেকে পিছে পড়ছেন। যেখানে উৎপাদিত পণ্যের দাম তুলনামূলক কম পাওয়া যাচ্ছে, সেখানকার মানুষের মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপ দানা বাঁধছে। কোনো অঞ্চলের পণ্য দ্রুত বড় বড় ভোক্তা বাজারে প্রবেশ করতে পারছে। কোনো অঞ্চল ভোক্তা বাজার খুঁজছে।
কখন কখন এমনও দেখা গেছে, দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্যে কৃষক নায্য মূল্য না পাওয়ায় মনের দুঃখে রাস্তায় রেখে গেছেন। অথচ ওই পণ্যই তখন দেশের বড় বড় বাজারে বেশ ভালো দামেই কেনাবেচা হয়েছে। যে অঞ্চলের কৃষক বা পণ্য উৎপাদনকারী পণ্যের নায্য মূল্য পান না তখন তাদের ভেতরে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়। কৃষকের মাঝে তৈরি হওয়া এই হতাশা, তার পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলে। আবার এই প্রভাব আপাতদৃষ্টিতে পরিবারের ওপর প্রযোজ্য মনে হলেও, প্রকৃত পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও যাপিত জীবনের নানান জায়গায় প্রভাব ফেলে। আমরা যা কিছু দেখি চোখ মেলেই দেখি, চোখ বুঁজলেও যে আমরা দেখি, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশের সব এলাকায় সুষমভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা গেলে, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানে গেলে, যে মেধা, যে অভিজ্ঞতা, যে মানবিক, যে দৃঢ়তা আমাদের দেশের মানুষের রয়েছে, তা তারা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে উদ্যেমী হয়ে উঠবেন তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সন্দেহাতীতভাবে এই উদ্যোগ দেশের সুষম উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে। দেশের উন্নয়ন বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন আরও সুষম হলে, শিল্প কলকারখানা ঢাকার বাইরের মফস্বল শহরগুলোর আশপাশে সুবিধা মতো জায়গায় স্থাপন বা স্থানান্তর করে শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে, দেশের যে উন্নয়ন এখন হচ্ছে, যে গতিতে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে যত বাধাই আসুক স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্টলিই এগিয়ে যাবে।
ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক