Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 9:02 pm

সুস্থ মানুষের ভিক্ষাবৃত্তি মহামারির মতোই ভয়ংকর

শারীরিকভাবে সক্ষম অর্থাৎ দৃষ্টিশক্তি থাকা এবং হাঁটাচলা করতে পারা মানুষের ভিক্ষা প্রার্থনাকে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও সুস্থ স্বাভাবিক ভিক্ষুকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। ব্যস্ত সড়কের মোড়ে, মাজার-দরগা, অফিস আদালতের পাশে কিংবা জনবহুল প্রতিটি স্থানেই ভিক্ষা প্রার্থীর আনাগোনা, গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সাহায্য চাওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যেখানে শারীরিকভাবে উপার্জনক্ষম মানুষের চেয়েও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সংখ্যা বেশি। যাদের মধ্যে দশ বছর বয়সের কম শিশু থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ বহু মানুষ আছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, দেখতে শুনতে অনেক সুদর্শন, কিন্তু মুখ লুকিয়ে হাত পেতে সাহায্য নিচ্ছেন রাস্তার দুপাশে বসে। এদের মধ্যে অনেকেই চুরি, ছিনতাই, মাদক বহনসহ নানা প্রকার অপরাধজনক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের দৃশ্যমান নানামুখী কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, বিপরীতে নানামুখী সমস্যার মধ্যে অন্যতম সক্ষম-অক্ষম মানুষের ভিক্ষাবৃত্তি।

যারা সত্যিই উপার্জনক্ষম এবং পরিবারে কেউ উপার্জন করার মতো কেউ নেই, তাদের ভিক্ষা প্রার্থনা স্বাভাবিক হলেও সুস্থ সবল মানুষের ভিক্ষা প্রার্থনা কাম্য নয়। সুস্থ মানুষের ভিক্ষাবৃত্তি মহামারির মতোই ভয়ংকর। কেননা পরিশ্রম করার মতো সামর্থ্য আছে এমন মানুষকে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে ধর্মীয়ভাবে, কাজ যতই ছোট হোক তাকে ছোট মনে করতে নেই বরং সৎপথে ইনকামের যৎসামান্য অর্থও মহামূল্যবান কিন্তু সুস্থ-সবল মানুষগুলো কেনো ভিক্ষাবৃত্তিতে আকৃষ্ট হচ্ছে তার একটা দৃশ্যমান কারণ, মানুষের কাছে হাত পাতলেও এখানে কোনো ঝামেলা নেই; বরং ভালোই আয় হয়, এ ভাবনা থেকে মানুষগুলো ভিক্ষাবৃত্তিতে নামলেও তা কাম্য নয়। পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তির আড়ালে অপরাধজনক কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত হচ্ছেন অনেকে, ভিক্ষুক বিধায় সন্দেহ করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর সুযোগ নিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে সুস্থ সবল পুরুষ-মহিলা নিজেদের চেহারা ও পোশাকে নিরীহ রূপ ধারণ করে তাদের শিশু সন্তানসহ ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হচ্ছে। নিজেদের তারা ভিক্ষুক হিসেবে মেনে নেয়ার পাশাপশি কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির শিক্ষা দিয়ে বিপথগামী করছে। পুঁজিবিহীন ও চিন্তাহীন ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে সহজে টাকা পাওয়ার কারণে ভিক্ষুদের দেখে অন্যরাও ভিক্ষাবৃত্তিতে আকৃষ্ট হচ্ছে। দিন দিন সুস্থ সবল ভিক্ষুকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মহামারির মতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। 

যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়, তাদের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক নারী-পুরুষ কেন কোনো কাজের ব্যবস্থা না করে মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা নিচ্ছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। মহিলাদের বাসাবাড়িতে কাজ করতে গেলে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হলেও গৃহস্থালির কাজ ছাড়াও গার্মেন্টসহ বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে কাজ করার সুযোগ থাকে। অধিকন্তু বহু নির্মাণশ্রমিকও আছে যারা নারী, কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন, তবুও কারও কাছে হাত পাততে রাজি নন তারা। পুরুষদের জন্য আছে আরও বহু কাজের সুযোগ, তারাও সেদিকে না গিয়ে সহজ আয়ের রাস্তা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন অথচ বহু মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরা রিকশা চালানো, নির্মাণশ্রমিক, নিরাপত্তাকর্মী, ছোটখাটো বহু ব্যবসা, দৈনন্দিন ভিত্তিতে বহু কাজসহ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, তবে বাস্তবতা হলো এক শ্রেণির ব্যক্তিরা ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে, বিপরীতে হতদরিদ্র এবং মধ্যবিত্তরা একই জায়গায় থাকছে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না তেমন, আর ভিক্ষুক-ভবঘুরেরা যেমন ছিল তেমন অবস্থায় দিন যাপন করছে। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের নানা উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডের মাঝে অন্যতম হতে পারে দেশকে ভিক্ষুক-ভবঘুরে মুক্ত করা, বাংলাদেশে বিদ্যমান বিভিন্ন মাজার-দরগাতে, অফিস-আদালতের সামনে এবং জনবহুল জায়গাগুলোতে অসংখ্য ভিক্ষুক আছে, যারা রাস্তায় বসে ভিক্ষা করে এবং রাস্তাতেই রাত্রীযাপন করে, এসব মানুষের পুনর্বাসন করার কোনো বিকল্প নেই।

রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নতি করার দায়িত্ব সরকারের ওপর হলেও নাগরিকদেরও থাকে কিছু দায়িত্ব। শিক্ষিত নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকলেও সরকার নাগরিকদের যোগ্যতানুসারে বিভিন্ন কমংসংস্থান বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন। তবে লেখাপড়া না জানা নারী-পুরুষদের জন্য বহু কর্মসংস্থান থাকলেও তাদের মধ্যে যারা ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ, এর দায় একান্তই ব্যক্তির ওপর, ব্যক্তির অনিচ্ছা ও সদইচ্ছা না থাকার কারণেই কর্মের দিকে ছুটে না গিয়ে সহজ পন্থায় আয় করার পথ হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন যা কাম্য নয়। এ শ্রেণির মানুষকে কর্মে আগ্রহী করার জন্য জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে ব্যক্তি উদ্যোগে কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। ভিক্ষা প্রার্থী কোমলমতি শিশুদের পড়ালেখার ব্যবস্থা ও তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা শারীরিক অক্ষমতার কারণে আয়-রোজগার করার মতো অবস্থায় নেই, তাদেরকে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য সব ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে, দুস্থ নাগরিকদের ভালো রাখার সব দায়িত্ব সরকারের। সেই সঙ্গে প্রত্যেকটি নাগরিক, তার ওপর অর্পিত নাগরিক দায়িত্ব এবং দরিদ্র-অসহায় মানুষের প্রতি ধর্মীয় নির্দেশনা পালন করলে দেশ থেকে দূর হবে ভিক্ষাবৃত্তি এবং সত্যিকার অর্থেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

জুবায়ের আহমেদ

কাঁটাবন, ঢাকা