আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারে বাড়ছে সূচক, সেইসঙ্গে বাড়ছে লেনদেনও। চলতি সপ্তাহের গত চার কার্যদিবসই টানা উত্থান হয়েছে পুঁজিবাজারে। একই সঙ্গে লেনদেন ছাড়িয়েছে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি। এদিকে আগস্ট মাসের শুরু থেকেই উত্থান শুরু হয় বাজারে। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে টানা পতন হয় পুঁজিবাজারে। এর পরের সপ্তাহে আবার ঘুরে দাঁড়ায় বাজার। আসে ব্যাংকের ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা শেয়ার ক্রয় মূল্যে নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এতে বাজার আরও চাঙা হয়ে ওঠে, মাঝেমধ্যে কিছুটা কারেকশন হলেও গতকাল পর্যন্ত বাজারের সূচক ও লেনদেন ছিল ঊর্ধ্বমুখী। তবে পুঁজিবাজারের এ ঊর্ধ্বমুখিতার ধারাবাহিকতা দীর্ঘ মেয়াদে অব্যাহত থাকা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বাজারসংশ্লিষ্টদের মাঝে। কারণ সূচক ও লেনদেন বাড়তে থাকলেও বাজারে যেসব ব্লু-চিপ কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোয় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়নি, যে কারণে বাজারের এ উল্লম্ফনের প্রভাব ব্ল–-চিপ কোম্পানিতে দেখা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি এবং বেশ কিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদর বাড়িয়ে কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য বাজারে লেনদেন বেড়েছে বলে জানান তারা।
গত চার কার্যদিবসের বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সপ্তাহের প্রথম দিনে সূচক বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৭০ পয়েন্ট। এদিন লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি। দ্বিতীয় কার্যদিবসে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়ে সূচক বাড়ে ৬ দশমিক ২০ পয়েন্ট। ২৪ দশমিক ৮০ পয়েন্ট বেড়ে তৃতীয় দিনে লেনদেন হয়েছে সাড়ে ১৭ কোটি টাকার বেশি এবং গতকাল দুই হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়ে সূচক বাড়ে ২৪ দশমিক ৪০ পয়েন্ট।
এর বিপরীতে ডিএসইতে ৩০টি ব্লু-চিপ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ‘ডিএসই-৩০ সূচক’ সপ্তাহের প্রথম দিন বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭০ পয়েন্ট। ৪ দশমিক ৩০ পয়েন্ট বাড়ে দ্বিতীয় কার্যদিবসে। তৃতীয় দিন বাড়ে ৪ পয়েন্ট এবং সর্বশেষ গতকাল ৩ দশমিক ৭০ পয়েন্ট বাড়ে এ সূচকে।
এদিকে গতকাল লেনদেন শেষে আলোচিত খাতের কোম্পানিগুলোর দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, সূচকটিতে লেনদেন হওয়া ৩০টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৬ কোম্পানির, এর বিপরীতে দর কমেছে ১১টি কোম্পানির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে তিনটি কোম্পানির শেয়ারদর। এ সূচকে লেনদেন হওয়া বাজার মূলধনের দিক থেকে ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি বাজার মূলধনের কোম্পানি গ্রামীণ ফোনের দর কমেছে। সেইসঙ্গে বছর শেষে ভালো লভ্যাংশ দেয়া বিএটিবিসি ও স্কয়ার ফার্মার দরও কমেছে। অপরদিকে যেসব কোম্পানির দর বেড়েছে, সেগুলোর দামও খুব বেশি বাড়েনি এবং লেনদেন হয়েছে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার কিছুটা বেশি। তাহলে এত লেনদেন হয়েছে কোন শেয়ারে, সে বিষয়ে চিন্তিত বাজারসংশ্লিষ্টরা।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেন বাড়লেও ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করছে না বিনিয়োগকরীরা। যে কারণে ব্লু-চিপ কোম্পানিগুলো যাদের ব্যবসা ভালো এবং বছর শেষে ভালো লভ্যাংশ দেয়, সেসব কোম্পানির দর কেন আশানুরূপ বাড়ছে না এবং লেনদেনের দিক থেকে খুব বেশি নয়। বাজারে মূলত কম সময়ে বেশি মুনাফা করার জন্য দুর্বল কোম্পানির শেয়ার এবং স্বল্প মূলধনির শেয়ারে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। এতে সেসব শেয়ারে অল্প বিনিয়োগে এবং কম লেনদেনেই দাম বেড়ে যায়। ফলে কম সময়ে একটি অংশ বিনিয়োগকারী ভালো মুনাফা করে নেয়। এজন্য বাজার ভালো হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত নজরদারি বাড়ানো। কোন শেয়ারে বিনিয়োগ হচ্ছে এবং দুর্বল কোন শেয়ারের দর অকারণেই বাড়ছে, সেদিকে নজর দিতে হবে, যাতে অকারণে শেয়ারদর বাড়িয়ে একটি চক্র মুনাফা না করে নেয় এবং অন্য বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাতে বাজারের আস্থা না কমে এবং ভালো শেয়ারে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাজারের এই উত্থানের ধারা অব্যাহত থাকে।
এদিকে গত ৩০ আগস্ট ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম মিলনায়তনে ‘ইআরএফ ডায়ালগ’-এ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে অর্থনীতির বিকাশ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় লুণ্ঠনও। সেই লুণ্ঠন সবচেয়ে বেশি হয় ঋণখেলাপির মাধ্যমে। লুণ্ঠনের দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে শেয়ারবাজার। আশির দশকে ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটের (ডিএফআই) শিল্প সংস্থার মাধ্যমে ঋণ দেয়া শুরু হয়। ওই সময় ভিত্তিহীন অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব ঋণই খেলাপির প্রথম উৎস, যা আজও বিদ্যমান। সেইসঙ্গে ১৯৯৬ সালে ভিত্তিহীন কোম্পানিগুলো প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। পরবর্তীকালে সেই কোম্পানিগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এভাবে শেয়ারবাজার থেকেও অর্থ লুট হয়েছে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাজার এখন কারসাজিকারীদের হাতে। তাদের কাজ হচ্ছে, ‘পাম্প করো এবং জাম্প করো,’ যে কারণে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের ফলো করছেন। এতে বাজারে লেনদেন ও সূচক বাড়ছে, কিন্তু ব্ল–-চিপ কোম্পানিতে কোনো প্রভাব পড়ছে না। এতে দেখা যাবে, শেষে যারা কারসাজিকারীদের ফলো করেছেন, তাদের মধ্য থেকে দু-একজন লাভবান হলেও বড় একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে একটি ব্রেকারেজ হাউসের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানান, বাজারে যে কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ হচ্ছে, তা প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি। যেসব শেয়ারে দাম বাড়ার বা বিনিয়োগ করার কোনো মানে হয় না, সেসব শেয়ারে দাম ও বিনিয়োগ শুধু বাড়ছেই। কারা বিনিয়োগ করছে, সেটাও আমরা দেখতে পারি, কিন্তু কিছু বলার সুযোগ নেই। কারণ যারা কারসাজি করছে, তারা বড় ও ক্ষমতাবান একটি চক্র। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত কঠিন নজরদারি করা।