এইচ এম সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ভোরের সূর্য উঁকি দিতেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে সূর্যমুখী ফুলেরা। দূর থেকে বিশালাকারের হলুদ গালিচা বিছানো মনে হলেও কাছে গেলে চোখে পড়ছে হাজারো সূর্যমুখী ফুল। বাতাসে দোল খেয়ে ফুলগুলো যেন সৌন্দর্য উপভোগের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আর সেই হলুদ ফুলের হাসিতে নিজেদের বৈকালীক সময় কাটাতেও ছুটে আসছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।
মনোমুগ্ধকর এমনি দৃশ্যের দেখা মিলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের গোয়ালখলা গ্রামে। বীজ উৎপাদন ও সংগ্রহের জন্য পতিত জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে বাজিমাত করেছেন কৃষক রাজিব আহমেদ। তিনি একসঙ্গে ছয় বিঘা ক্ষেতজুড়ে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে এখন দেখছেন লাভের স্বপ্ন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বিজয়নগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতেই পতিত জমি ব্যবহার করে তেল জাতীয় ফসল সরিষার পাশাপাশি সূর্যমুখীর আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বছর প্রায় ১৩ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে। উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের গোয়ালখলা গ্রামের মাঠে একসঙ্গে ছয় বিঘা পতিত জমিতে প্রথমবারের মতো সূর্যমুখীর আবাদ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন গোয়ালখলা গ্রামের কৃষক রাজিব আহমেদ।
এক সময় পুরো জায়গাটি খালিই পড়ে থাকত, কোনো কিছুই আবাদ করতেন না। দীর্ঘদিন পতিত হয়ে পড়ে থাকা জমিতে সূর্যমুখীর হাসিতে পুরো এলাকার চিত্রই যেন পাল্টে গেছে। প্রতিদিন প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসছেন হলুদ ফুলের হাসিতে নিজেদের মন সতেজ করতে। দূর থেকে বিশালাকারের হলুদ গালিচা বিছানো মনে হলেও কাছে গেলেই হাজারো সূর্যমুখী ফুলের হাসিতে নয়ন জুড়ায়। বাতাসে দোল খাওয়া ফুলগুলো যেন সৌন্দর্য উপভোগের আমন্ত্রণ জানিয়ে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা করে।
রাজিবের দেখাদেখি এখন স্থানীয় অনেকেই সূর্যমুখী আবাদে হয়ে উঠছেন আগ্রহী। কোনো জমি পতিত রাখা যাবে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাকে বাস্তবায়নে সংশ্লিস্ট ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার, উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাও সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কৃষক রাজিব আহমেদ জানান, বিগত ১২ বছর ধরে এই জমিতে কোনোকিছুই আবাদ করতাম না, খালি পড়ে থাকত। এ বছর কৃষি বিভাগের স্যারেরা আমাদের সঙ্গে এসে মতবিনিময় সভা করে ওই জমি সূর্যমুখী চাষের উপযোগী বলে জানান। সূর্যমুখী চাষ করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আশ্বাস দেয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার ছয় বিঘা জমিতে এবারই প্রথম সূর্যমূখী চাষ করি। ফসলের অবস্থা ভালো। সূর্যমূখী ফুল দেখতেও অনেকে ছুটে আসেন।
ফুলের মুগ্ধতায় আনন্দ পাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই আবার কীভাবে আবাদ করেছি তাও জানতে চান। ফসলের অবস্থা, ফুলের সৌন্দর্য উপভোগে অনেকেই আগামীতে সূর্যমুখীর আবাদ করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। উপজেলার উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রায়ই সূর্যমুখী জমি পরিদর্শন করাসহ রোগবালাই এবং পোকা-মাকড় দমনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর বিজয়নগর উপজেলায় ১৩ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ মেট্রিক টন, যা থেকে প্রায় আট হাজার ৪০০ লিটার তেল উৎপাদিত হবে। প্রতি লিটার ২০০ টাকা বাজার মূল্য ধরে প্রায় ১৬ লাখ আট হাজার টাকার তেল বিক্রি হবে। সূর্যমুখীর বীজ ভাঙিয়ে তেল করার আলাদা কোনো যন্ত্র না থাকায় কৃষক সূর্যমুখী আবাদে তেমন আগ্রহী নন।
ভুতর্কি মূল্যের আওতায় কৃষকদের সূর্যমূখী ভাঙানোর যন্ত্র প্রদান করা গেলে সূর্যমুখীর আবাদ আরও বৃদ্ধি করা যাবে। এতে করে একদিকে বিজয়নগর উপজেলায় দিন দিন তেল জাতীয় আরেকটি ফসল সূর্যমুখীর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং বিদেশ থেকে তেলের আমদানির নির্ভরতা কমবে এবং কৃষকরা হবেন আর্থিকভাবে লাভবান। নিজের উৎপাদিত ভেজালমুক্ত সূর্যমূখীর তেল নিজে খাওয়ার পাশাপাশি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন।
স্থানীয় উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোহা. নুরে আলম জানান, ‘অনাবাদি পতিত জমিকে আবাদের আওতায় আনার বিষয়ে আমরা স্থানীয় কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ প্রদান করে আসছি। পত্তন ইউনিয়নের গোয়ালখলা মাঠটি আগে পতিত ছিল বিগত এক যুগ ধরেই। এ বছর উপজেলা কৃষি অফিসারের নির্দেশনায় স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে পতিত জমিকে আবাদের আনার বিষয়ে মতবিনিময় সভা করায় কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে সূর্যমুখীর আবাদে সম্মত হন এবং কৃষক রাজিব আহমেদ একসঙ্গে ছয় বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করেন।’ তিনি আরও জানান, সূর্যমুখী একটি উৎকৃষ্টমানের তেল জাতীয় ফসল। এতে থাকা শতকরা ৪২-৪৫ ভাগ লিনোলিক এসিড হার্টের রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী।
অপরদিকে এতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকার পদার্থ ইরোসিক এসিড নেই। সূর্যমুখীর বীজে তেল থাকে শতকরা ৪০-৪৪ ভাগ। এর খৈলও গবাদিপশুর উৎকৃষ্ট খাবার। সংশ্লিষ্ট ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসারসহ আমি নিয়মিত তাদের জমি পরিদর্শন করে সূর্যমুখীর পাতা ঝলসানো রোগ, গোড়া পচা রোগ ও বিছা পোকাসহ ইত্যাদি রোগবালাই দমন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছি। এতে কৃষকরা দিনকে দিন সূর্যমূখী আবাদে আরও উৎসাহী হবেন বলে আশা করছি।
বিজয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাব্বির আহমেদ জানান, সুর্যমূখী একটি উৎকৃষ্টমানের তেল জাতীয় ফসল। বিজয়নগর উপজেলায় আগে সূর্যমুখী ফসলের তেমন আবাদ হতো না। এ বছর আমরা উঠান বৈঠক, মতবিনিময় সভা, মাঠ দিবস, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে ১৩ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ করতে সক্ষম হয়েছি। আগামী দিনগুলোয় সূর্যমুখীর আবাদ আরও বাড়বে বলে আশাবাদী।’