সৃষ্টির বর্ণিল মানববৈচিত্র্য

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্বকের রং নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আমরা অপেক্ষাকৃত গাঢ় বর্ণ অথবা কালো ত্বকের মানুষের মধ্যে ফর্সা হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করে থাকি। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, পৃথিবীব্যাপী কালো বর্ণের মানুষের চাইতে মিশ্র বর্ণ বা শ্যামলা বর্ণের মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা বহুগুণ বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা তীব্র। অনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসী প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশেও এই প্রবণতা সমস্ত উদাহরণ ছাপিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কোনো কালো নারীকে আমি সংবাদ পাঠ করতে কিংবা বিজ্ঞাপনে অভিনয় করতে দেখিনি।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো সারাদিন নারীর অধিকার নিয়ে টকশো ও খবর প্রচার করে; অথচ তারা নিজেরাই এই বৈষম্য সৃষ্টি করে। প্রতিটি মানুষই সুন্দর, হয়তো ফর্সা নয়। যারা টিভিতে সংবাদ পাঠ বা বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেন, তাদের অবশ্যই ফর্সা হতে হবে। সৌন্দর্য নিয়ে হীনম্মন্যতাবশত শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও মানুষকে নানা ধরনের পরামর্শক এবং বিউটি পার্লারে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়।

যে অনুষ্ঠানে ‘নারীদের এগিয়ে আসা’ নিয়ে আলোচনা হয়, সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কখনও কালো নারী হন না। তারা আবার সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা দেন, যা হাস্যকরও বটে। কেন জানি, যে মেয়েদের শরীরের রং কালো, তাদের ভেতর অন্য কোনো যোগ্যতা আছে কি না, তা খুঁজে বের করা হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকেই এই দৃষ্টিভঙ্গি শেকড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রের মুখ্য চরিত্র, অর্থাৎ নায়ক-নায়িকা ও পাত্র-পাত্রীকে হতে হয় উজ্জ্বল বর্ণের, তা না হলে চলে না। আনুষ্ঠানিক বিয়ের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই! একটি সুশ্রী, স্বাস্থ্যবান মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধও ভেঙে যায় শুধু গাত্রবর্ণ ফর্সা না হওয়ার কারণে।

এই উপমহাদেশে কেন ফর্সা মেয়ের এত কদর? ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন অধিবাসীরা ছিল কালো। এই ভূ-প্রকৃতির মানুষ শ্যামবর্ণ হবে, তা-ই স্বাভাবিক। পরবর্তীকালে আর্যরা এলো, তারা ছিল ফর্সা। সেই সময়ই আর্যরা অন্যদের নিচু মনে করত। আমার ধারণা শত শত বছরের মানসিক ছাপ এখনও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। 

আমাদের সবার মায়েরা কি ফর্সা? তাদের কি কখনও আপনার অসুন্দর মনে হয়েছে? ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে কালো মেয়েকেই অধিক সুন্দর মনে করা হয়, আবার অনেক দেশে ফর্সা মেয়েকে। এটা পরিবেশ ও ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত। সৌন্দর্য কালো অথবা সাদার ওপরে নির্ভর করে না। আমাদের ত্বকের স্বাভাবিক যে মেলানোসাইড সেলগুলো রয়েছে, যা রঞ্জক তৈরি করে, তা-ই আমাদের গায়ের রং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কালো অথবা সাদা একটি ‘রং’ ছাড়া আর কিছু নয়। রং কথা বলতে বা গান গাইতে পারে না। রং নেহাত কিছু কেমিস্ট্রির খেলা। কালো মেঘ দেখলে অনেকের ভালো লাগে। কালো কাজল ভালো লাগে। চোখ ভালো লাগে। কিন্তু শুধু কালো মানুষ দেখলেই বলে ওঠেÑ‘অসুন্দর।’ ফর্সা হওয়ার লোভ কেন মানুষকে পেয়ে বসেছে, যারা নিজের সুস্বাস্থ্যের কথাও হেলায় উপেক্ষা করছে! কী বিচিত্র নিয়মকানুন!

সৃষ্টির বৈচিত্র্য পৃথিবীকে করেছে আলোকিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি, মানববৈচিত্র্যকে আমরা জানাই শ্রদ্ধা ও ভক্তি। এখনই সময় বৈচিত্র্যকে মূল্যায়ন করার হোক সে ভিন্ন ধর্মের, বর্ণের, লিঙ্গের অথবা জাতির। পৃথিবীর স্বার্থে যে কোনো ধর্মের, বর্ণের, লিঙ্গের অথবা জাতির সব মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে। 

আইনজীবী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০