প্রতিনিধি, রংপুর: তৃতীয় লিঙ্গের সুবর্ণা, শশী ও সানি। একসময় তারা দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলতেন। কখনও শহরের রাস্তাঘাট ও পাড়া-মহল্লায়, নয়তো বিয়েবাড়িতে দেখা যেত তাদের। আবার কখনওবা বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে। এসব জায়গায় সপ্তাহের কোনো না কোনো দিন দেখা মিলত তাদের। চাঁদা না পেলে গালাগালি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অপদস্থ করে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করা, নয়তো তর্কে জড়ানো ছিল তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষ আর আগের সেই অবস্থানে নেই। রঙিলা সাজ আর হাততালি দিয়ে তাদের চাইতে হয় না চাঁদা। কুটিরশিল্পের কাজে জড়িয়ে তাদের অনেকেই এখন কর্মক্ষম। নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের দেখভাল করছেন।
সুবর্ণা, শশী, সীমার মতো প্রশিক্ষণ পাওয়া বাবু, রুবেল, রুমা, অপু, দোলা ও সজলও একই স্বপ্ন দেখছেন। তারা চান সবাই নিজেদের উপার্জিত আয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। সমাজের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে ‘ন্যায় অধিকার হিজড়া উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন আনোয়ারা ইসলাম রানী। এই সংগঠনের মাধ্যমে রংপুর নগরীর নজরুল চত্বর এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের হস্ত ও কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের অনেকেরই কম্পিউটার, বিউটি পার্লার, দর্জি ও রান্নাবান্নার প্রশিক্ষণ রয়েছে। শুধু মূলধন আর কাজ করার জায়গা ও পরিবেশ না পাওয়ায় পিছিয়ে পড়েছে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী।
বর্তমানে প্রশিক্ষণ শেষে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, ফুলদানি, মাটির কার্টেল, কয়েলদানি, কলমদানিতে নকশাসহ বিভিন্ন ধরনের শোপিস তৈরি করা শিখছেন তারা। এসব কাজ করে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয় তাদের। অন্যদিকে তাদের উৎপাদিত এসব হস্তশিল্প ক্রয় করছে রূপায়ণ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
আগে মানুষের কাছে হাত পাতলেও বদরগঞ্জের কোহিনুর আট মাস ধরে হস্তশিল্পের কাজ করছেন। কোহিনুর বলেন, কাজ করে দুই টাকা রোজগার করে বেঁচে আছি। এসব হয়েছে গুরুমা আনোয়ারার কল্যাণে। তার কারণেই আজ আয়ের বাড়তি টাকা আমার পরিবারকেও দিতে পারছি।
রংপুর নগরীর তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নেতৃত্বে থাকা আনোয়ারা ইসলাম রানী থাকেন নুরপুর এলাকায়। আর ১০টা সন্তানের মতো চান মিয়া ও জুলেখা দম্পতির ঘরে তার জš§। কিন্তু জšে§র পর ১২ বছর বয়সে আনোয়ারা তার শারীরিক পরিবর্তন বুঝতে পারেন। তাকে নিয়ে সহপাঠী, প্রতিবেশী ও বন্ধুরা শুরু করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। ২০০৯ সালের ঘটনা, আনোয়ারার সঙ্গে মোহন নামে এক হিজড়ার পরিচয় হয়। তখনই তিনি হিজড়াদের কমিউনিটিতে যোগ দেন। একদিন অন্য হিজড়াদের সঙ্গে চাঁদা তুলতে বের হলে মারধরের শিকার হন আনোয়ারা। তখনই সিদ্ধান্ত নেন যেন আর কারও কাছে হাত পাততে না হয়, সমাজের আর দশজন মানুষের মতো যেন জীবিকার পথ হয় সেই ব্যবস্থাই করবেন।
এমন ভাবনা থেকেই ২০১৯ সালে ঢাকার একটি কালচারাল প্রোগ্রামে আনোয়ারার সঙ্গে পরিচয় হয় মানব ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিচালক আলামিন গগনের। তার সহযোগিতায় তিনি হস্তশিল্পের কাজ শেখেন। এরপর রংপুরের নজরুল চত্বর এলাকায় ভাড়া বাসায় সংগঠনের সদস্যদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগিয়ে দেন। এখন পর্যন্ত শতাধিক হিজড়া প্রশিক্ষণ নিয়ে শাড়ি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, ফুলদানি, মাটির কার্টেল, কয়েলদানি ও কলমদানিতে নকশাসহ বিভিন্ন ধরনে শোপিস তৈরি করে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করছেন।
আনোয়ারা ইসলাম বলেন, আমরাও মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের কাছে হাত পাতা কতটা যন্ত্রণার, এটা শুধু তারাই বোঝেন যারা এমন পরিস্থিতিতে পড়েন। আমি হিজড়াদের হাত পেতে চাঁদা তোলা থেকে বের করে আনার ক্ষুদ্র চেষ্টা করছি। শতাধিক হিজড়া এখন হস্তশিল্পের কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে কারুপণ্যে ২০ জন চাকরি করছেন। তারা নিজেদের খরচ বাদেও পরিবারে অর্থের জোগান দিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সংগঠনটিকে ২০১৭ সালে সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে রংপুর বিভাগের চার শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রয়েছেন। তারা প্রতি মাসে সংগঠনের তহবিলে ২০০ টাকা করে জমা রাখেন। এ টাকা তাদের ও সমাজের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশে প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার। তবে এই জনগোষ্ঠীর দাবি, দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা দেড় থেকে দুই লাখ। সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে তাদের জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি চালু করে। স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে বিশেষ ভাতা দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ শেষে অনুদানও দেয়া হচ্ছে।
রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল মতিন জানান, জেলার তালিকাভুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্য থেকে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে অনেকে বয়স্কভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন। অনেকে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। প্রশিক্ষিতদের অনেকে স্বাবলম্বীও হয়েছেন।