মো. আসাদুজ্জামান: জীবন যাপনে প্রয়োজন অর্থকড়ি। আর সংরক্ষিত অর্থকড়ি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে। শত বছর আগের মুদ্রাব্যবস্থা দেখে সেই সময়ের সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য খুব সহজে বোঝা যায়। মুদ্রা জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখে বিশ্বের নানা দেশ। কালক্রমে শুধু মুদ্রাকেন্দি ক জাদুঘরও গড়ে তোলা হয় নানা দেশে, যা আকৃষ্ট করে দর্শনার্থীদের।
আমাদের দেশেও এমন একটি কারেন্সি মিউজিয়াম বা মুদ্রা জাদুঘর রয়েছে। এটি টাকা জাদুঘর নামে পরিচিত। রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমি ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্থাপন করা হয়েছে টাকা জাদুঘর।
২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল ভবনের ফলক উšে§াচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন থেকে এর কাজ শুরু হয়। ওই বছরের ৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এটি উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে দর্শনার্থীদের জন্য এটি খুলে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ২০০৯ সালে স্থাপিত হওয়া কারেন্সি মিউজিয়ামের আধুনিক সংস্করণ এ টাকা জাদুঘর।
মুদ্রা সম্পর্কিত একটি বিশেষায়িত জাদুঘর এটি। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে মুদ্রার ক্রমবিকাশ ধারা লালন, সংরক্ষণ, উপস্থাপন ও বিশ্বের নানা দেশের মুদ্রার ইতিহাস দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরা এর মুখ্য উদ্দেশ্য।
এখানে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে প্রাচীন আমল থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত মুদ্রিত নানা ধাতব মুদ্রা, কাগজের নোট ও মুদ্রা সম্পর্কিত দ্রব্যসামগ্রী। ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত প্রচলিত পাঞ্চ মার্কড (রৌপ্য মুদ্রা) রয়েছে এখানে। রয়েছে কুষাণ মুদ্রা, হরিকেল মুদ্রা, দিল্লি ও বাংলার সুলতানদের মুদ্রা, মোগল ও ব্রিটিশ শাসকের মুদ্রাসহ আধুনিক মুদ্রা সম্ভার। কুষাণ সম্রাটদের প্রদত্ত শক পার্থিয়ান ও তাম্রমুদ্রার কিছু নমুনাও রয়েছে এখানে। এগুলো খ্রিস্টাব্দের প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে ব্যবহার হতো। হরিকেল মুদ্রার প্রচলন ছিল মূলত সপ্তম ও অষ্টম খ্রিস্টাব্দের দিকে বর্তমান সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লার ময়নামতী, চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে। উল্লেখ্য, ময়নামতীর প্রতœস্থল থেকে বিপুল হরিকেল মুদ্রা পাওয়া যায়।
উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলে লেনদেনে মুদ্রা হিসেবে কড়ি ব্যবহার করা হতো। সেসব কড়ির কিছু নমুনাও রয়েছে এ জাদুঘরে। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামল তথা সুলতানি শাসনামলে (চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে) ২৬ জন শাসক বাংলার নানা টাঁকশাল থেকে মুদ্রা জারি করেন। এখন পর্যন্ত ৪০টি টাঁকশালের নাম পাওয়া গেছে। গজনির সুলতান মাহমুদ সর্বপ্রথম মুদ্রাকে টঙ্কা বা টাকা হিসেবে প্রচার করেন। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশ তার স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার নাম দিয়েছিলেন ‘তানকাহ’ বা টাকা। এ ছাড়া টাকা জাদুঘরে রয়েছে মোগল আমলের কোচ ও অহম বা আসাম মুদ্রা।
টাকা জাদুঘরে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ, মোগল সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, ফররুখশিয়ার ও ব্রিটিশ ভারতীয় স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র মুদ্রা ও কাগজের নোট। একই সঙ্গে পাকিস্তান আমল, স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা ও কাগজের নোটের ধারাবাহিক ইতিহাস দেখতে দেখতে সময় কাটাতে পারবেন।
জাদুঘরে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২০টি দেশের কাগজ, পলিমার ও হাইব্রিড নোটসহ ধাতব মুদ্রা রয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সাবেক চেকোসেøাভাকিয়া, ইতালি, আফগানিস্তান, চীন, ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ, ভিয়েতনাম, লিথুয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও কমিউনিস্টশাসিত পোল্যান্ডের পুরোনো ব্যাংক নোট, চেক ও বন্ড আছে। বর্তমান সময়ের যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেপাল, ভুটান, ভারত ও পাকিস্তানের মুদ্রা রয়েছে টাকা জাদুঘরে।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, দিবস ও বরণীয় ব্যক্তিদের স্মরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ১২টি স্মারক মুদ্রা ও ৪টি স্মারক নোট প্রকাশ করেছে। এগুলোর মধ্যে ১টি সোনার, একটি নিকেলের ও বাকিগুলো রুপার মুদ্রা। মুদ্রা তৈরির ডাইস, মুদ্রায় নির্মিত বাংলার ঐতিহ্যবাহী অলঙ্কার, বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা দ্রব্যাদি, শস্য সংরক্ষণে রাখা মাটির মটকি প্রভৃতি দর্শনার্থীদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবে ঐতিহ্যের সঙ্গে।
সময়ের প্রয়োজনে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে চলেছে টাকা জাদুঘর। এখানে আছে ডিজিটাল সাইনেজ, ডিজিটাল কিয়স্ক, এলইডি মনিটর, থ্রিডি মনিটর, প্রজেক্টর ও ফটো কিয়স্ক। ডিজিটাল সাইনেজ দিয়ে তথ্যকে আধুনিক প্রক্রিয়ায় দেখানো হচ্ছে। ডিজিটাল কিয়স্ক দিয়ে ভিডিও চিত্র ও তথ্য ধারণ করা হয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা হাতের স্পর্শে নিমিষে পেয়ে যান মুদ্রাসম্পর্কিত তথ্য। এলইডি টিভিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যাবলি দেখানো হচ্ছে। চাইলে দর্শনার্থীরা নিজের ছবি সংবলিত স্যুভেনির নোট মুদ্রণ করে নিয়ে যেতে পারেন ফটো কিয়স্কের মাধ্যমে। অডিও গাইডের মাধ্যমে মুহূর্তেই জাদুঘর ও মুদ্রা সম্পর্কে অজানা সব তথ্য অনায়াসে জানতে পারবেন।
মুদ্রা জাদুঘরে একটি স্যুভেনির শপ রয়েছে। চাইলে নানা দ্রব্য, স্মারক মুদ্রা, জাদুঘর কর্তৃক প্রকাশিত প্রকাশনা প্রভৃতি কিনতে পারবেন।
সৌন্দর্য বর্ধনে রয়েছে টাকাগাছ। এ ধরনের গাছে নানা মুদ্রা ও নোটের রেপ্লিকা শোভা পাচ্ছে। টাকা জাদুঘরের পরিসর বাড়িয়ে গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, মাল্টিপারপাস সিনেপ্লেক্স করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী, গবেষক, দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে দেশের একমাত্র এ টাকা জাদুঘর। দর্শনার্থীর জন্য জাদুঘরটি শনিবার থেকে বুধবার বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ ছাড়া খোলা থাকে শুক্রবার বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার ও সরকারি ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ থাকে।
Add Comment