শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: বাংলাদেশের সমুদ্রবেষ্টিত ছোট দ্বীপ সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য খুবই মুল্যবান এ দ্বীপটি। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। তাই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সমুদ্র ঘেরা এই ভুখণ্ডটি খুবই আকর্ষণীয়। দ্বীপটির পাশে মিয়ানমার। এ অঞ্চলটিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে জলবেষ্টিত সমুদ্র দ্বারা। রাখাইন প্রদেশের আরাকান আর্মি কর্তৃক সহিংসতায় রোষানলে পড়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গারা টেকনাফ এলাকার জলসীমা অতিক্রম করে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়। গণমাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদ তথ্য থেকে জানা যায়, মিয়ানমারের নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ সেন্টমার্টিনের ওপর নজর রাখছে। যে কোনো সময় তারা দ্বীপটির বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থান নিতে পারে আরাকান আর্মিকে প্রতিহত করার অজুহাতে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী দ্বীপটিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সেন্টমার্টিন মূল খণ্ড থেকে দূরে, এখানকার অধিবাসীদের পেশা মৎস্য শিকার। এখানকার মাছ দিয়ে তৈরি শুঁটকি সারাদেশের চাহিদা মেটায়। দ্বীপটিতে ধান বা অন্যান্য ফসলের চাষ হয় না। ব্যবসায়ীরা টেকনাফ থেকে ট্রলারে করে খাদ্যপণ্যসহ সকল প্রকার প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে যায় সেন্টমার্টিনে। যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বেশ কয়েকবার অসামারিক নৌযান চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে চরম সংকটে পড়তে হয়েছে দ্বীপবাসীদের। যতটুকু ট্রলার চলাচল করে তাও আবার নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবাধনে। গত ভরা পর্যটন মৌসুমেও পর্যটকদের দ্বীপটিতে যাওয়ার বিষয়ে নিষিদ্ধ করেছিল নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সেন্টমার্টিন বিষয়ে মিয়ানমারকে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। বাংলাদেশের মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলবেষ্টিত সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এ এলাকাগুলোয় আরাকান আর্মি বাহিনী প্রবেশ করে নানা অপকর্ম করে পালিয়ে যাচ্ছে। বারবার শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মর্টার শেলের আঘাত করছে সীমান্ত এলাকায়। পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সীমান্তবর্তী কৃষিজমিগুলোয় চাষ করতে গিয়ে কৃষকরা নিরাপত্তায় হীনতায় ভুগছে। আরকান ও মিয়ানমার বাহিনীর উত্তেজনার রোষানলে পড়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে বেসামরিক বাংলাদেশি নাগরিকদের। মিয়ানমারের সংঘর্ষের হামলার খবর বিশ্লেষণে এটা প্রমাণ হয়, মিয়ানমার থেকে যে পরিমাণ হামলা করা হয়েছে বাংলাদেশের ওপর, তার পাল্টা উত্তর দেয়া হচ্ছে না বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। গত ১৯ জুন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট নিরসন করবে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সহিত আলোচনা করে কি আজ পর্যন্ত কোনো সংকট নিরসন করতে পেরেছে? প্রায় ১৫ লক্ষাধিক মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিক তিন যুগের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশে পড়ে আছে। বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে বড় সংকট হলো রোহিঙ্গা সমস্যা। প্রায় ৭০ বছর ধরে হয়ে যাবে রোহিঙ্গা সমস্যা। এই দীর্ঘ সময়ে কী মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে? মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের আহ্বানে কোনো ইতিবাচক সাড়া দিয়েছি কি কোন সময়? নিবিড়ভাবে ভাবতে গেলে দেখা যায়, মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের কোনো কথাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ১৯৬২ সালে জেনারেল নেউইন ক্ষমতা দখলের পর থেকেই এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নাগামান (ড্রাগন রাজা) অভিযান চালায় রাখাইন প্রদেশে। এই অভিযানে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। ১৯৮২ সালেও অনেক রোহিঙ্গা নানাভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৯৭৮ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কিন্তু এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রতিকার অ্যামনেস্টি গত ৩৮ বছরের করতে পারেনি। প্রতি বছরই কোনো না কোনোভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে তবে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে চার-পাঁচবার। ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে রোহিঙ্গা এবং বৌদ্ধদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয় ওই সময় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। ১৯৯২ থেকে ২০২৪ সাল রোহিঙ্গা আসছে তো আসছে। বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল থামছে না।
রাষ্ট্রগুলোর অভিভাবক জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসছে সেই সম্পর্কে স্থায়ী কোনো সমাধানের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না জাতিসংঘকে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের শনণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ নেয় কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এই অভিযোগে তা ভেস্তে যায়। ২০১৬ সালে আবার দাঙ্গা দেখা দেয় মিয়ানমারের। তখন লাখে লাখে রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গা দাঙ্গা ১৯৪৬ থেকে ২০২৪ প্রায় ৭৮ বছরের বিবদমান একটি সমস্যা। ২০১৬ সালের পর থেকে দেখা যায় আজবধি প্রতি মাসেই কিছু কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে নানা আলোচনার কথা শোনা যায়, জাতি সংঘসহ পৃথিবীর নানা দেশে তবে মিয়ানবার এই আলোচনায় কর্ণপাতও করছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়েছে, এই মামলার ফলে কি রোহিঙ্গারা স্ব দেশে ফিরতে পারছে বা এই মামলার কারণে মিয়ানমার সরকারের কোনো উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এসেছে বাংলাদেশে আলোচনার জন্য। মিয়ানমারের উগ্রবাদ কেন ঠেকানো যাচ্ছে না। মিয়ানমারের উগ্রবাদের সৃষ্ট কুফলটা বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, এই বিরাট সমস্যার দায়ভার পোহাতে হচ্ছে বাংলাদেশের। আরকান আর্মির দাঙ্গার কারণে বাংলাদেশকে আশ্রয় দিতে হলো ১৫ লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে। এই সমস্যাটি কেন কোনো আলোচনায় মীমাংসা হচ্ছে না। আইএসপিআরের সংবাদ সূত্র থেকে জানা যায়, দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের ভূখণ্ড রক্ষা করবে। মানুষের আস্থার জায়গাটা একটু প্রশ্নবিদ্ধ এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে। কারণ ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ নাগরিক হত্যার বিষয়টি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের আলোচনা হয় বছরে দু’একবার করে। আলোচনা শেষে প্রেস ব্রিফিং করা হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, বিএসএফ কর্তৃক গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা জিরোতে নামানো হবে। এত আলোচনার পর কি বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বন্ধ হয়েছে। বাস্তব প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, প্রতি মাসেই দু’একজন বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। মিয়ানমারের বিষয়টি ভারতের চাইতে মারাত্মক। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত রেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩ কিলোমিটার। এই দৈর্ঘ্য রেখায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকরা চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। প্রায়ই শোনা যায় আরকান আর্মি ও নাসাকা বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেল সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসে পড়ছে। ১৬ জুন ২০২৪ তারিখের বিবিসির সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে; তবে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের ব্যাপক সংঘর্ষ অব্যহত থাকায় টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যে পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে নাফ নদীতে মিয়ানমারের কোনো যুদ্ধ জাহাজ দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছে, মিয়ানমারের গানবোট ও নেভাল শিপ নাফ নদীতে অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশের উচিত, মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজগুলো বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করছে কি না তা দেখা? যদি করে থাকে তাহলে বাংলাদেশের উচিত পাল্টা জবাব দেয়া। দেশের কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, নাফ নদীতে মিয়ানমারের আর্মি এসেছিল আরকান আর্মিদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করার জন্য। তাদের আরও ধারণা, আরকান আর্মি যদি মিয়ানমারের মংডু দখল করে নেয় তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুটা সুরাহা হবে না, এখন যদি মিয়ানমার বাহিনী কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে আরকান আর্মিকে প্রতিহত করতে চায় তাহলে কি তাদের প্রশয় দেয়াটা যৌক্তিক হবে? মানবতার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে চরম মাশুল দিতে হচ্ছে। তাই বাংলাদেশকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। কারণ দেশবাসীর কাছে সেন্টমার্টিন ইস্যুটিতে নানা ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত এই ধূম্রজালটি নিরসনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াসহ ব্যাখ্যা দেয়া।
উন্নয়ন কর্মী ও মুক্ত লেখক
shahzia84@yahoo.in