Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 1:20 pm

সেফটি ইঞ্জিনিয়ার এসএসসি পাস খরচ কমাতে পদে পদে ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি কোম্পানি চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনে (সিজিজিসি) ‘সেফটি ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে গত বছর নিয়োগ পান জুলফিকার আলী শাহ। বিমানবন্দরসংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তরার আজমপুর পর্যন্ত নির্মাণকাজে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ছিল তার। গার্ডার চাপায় পাঁচজনের মৃত্যুর মামলায় জুলফিকারকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানাচ্ছে, তার কোনো কারিগরি শিক্ষা নেই, তিনি এসএসসি পাস করেই এত বড় প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পান।

দুদিন আগের ওই ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করার পর গতকাল বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথে বিশেষ লেনের মাধ্যমে বাস চলাচলের জন্য এক দশক আগে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। মূল নির্মাণকাজের ঠিকাদারি পায় চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান-চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ও ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ। গার্ডার দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সিজিজিসির নির্মাণাধীন অংশে।

র‌্যাবের কমান্ডার আল মঈন বলেন, সিজিজিসির ‘সেফটি ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে ৩৯ বছর বয়সী জুলফিকার ২০২১ সালে নিয়োগ পান। অথচ তিনি এসএসসি পাস। এত বড় প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ তার নেই। প্রকল্পের বিমানবন্দরসংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তরার আজমপুর এলাকা পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার দিনে ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী বসাননি। গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত লোকও নিয়োগ করেননি।

পাঁচ বছরের এ প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায় তা চরম গণভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। প্রকল্পের আকার এখন ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়ালেও র‌্যাবের তথ্য বলছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিয়েই খরচ কমানোর চেষ্টা করে গেছে। দুর্ঘটনাস্থলে যে ক্রেনটি ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেটির বয়স অন্তত ২৬ বছর।

র‌্যাবের কর্মকর্তা আল মঈনের ভাষ্য, তারা আনুমানিকভাবে বলেছে যে ক্রেনটি ৯৬-৯৭ সাল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছিল, এটি মেয়াদোত্তীর্ণ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বক্তব্য অনুযায়ী ওই ক্রেন দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ টন ওজন ‘কম্ফোর্টেবলি’ তোলা যায়। আর ওই ক্রেইনটি দিয়ে যখন সোজাসুজিভাবে না তুলে তেরছাভাবে তোলা হয়, তখন সেটির ভার বহন সক্ষমতা আরও কমে যায়। সেখানে যে গার্ডারটি ছিল সেটির আনুমানিক ওজন ৬০ থেকে ৭০ টন। যার কারণে যিনি ক্রেইনটি চালাচ্ছিলেন, সেই হেলপার রাকিব নিয়ন্ত্রণ হারান।

জুলফিকারের তত্ত্বাবধানে দুর্ঘটনাস্থলে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক ম্যান হিসেবে রুবেল ও আফরোজ নামে দুজন নিয়োজিত ছিলেন। তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেননি। রুবেল ও আফরোজকে নেয়া হয়েছে ফোর ব্রাদার্স গার্ড নামের একটি ‘নাম সর্বস্ব’ কোম্পানি থেকে।

র‌্যাব জানিয়েছে, এ কোম্পানির কোনো লাইসেন্স নেই। রুবেল তিন মাস আগে ও আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডে যোগ দেন। যোগদানের পর তাদের নিরাপত্তা বা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ না দিয়েই কাজে পাঠানো হয়।

মঈন বলেন, এখানে কমপক্ষে দুজন সিগন্যাল অপারেটর থাকার কথা ছিল, যারা মূলত ক্রেনকে গাইড করে। কিন্তু ঘটনার সময় এ ধরনের কোনো সিগন্যাল অপারেটর সেখানে ছিল না। এই গার্ডার তোলার ক্ষেত্রে কাউন্টার লোড ব্যবহার করা উচিত ছিল, যেটা হয়নি। আরেকটি ক্রেন স্ট্যান্ডবাই রাখা উচিত ছিল, সেটিও রাখা হয়নি।

র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার নয়জন হলেন ক্রেন অপারেটর আল আমিন হোসেন হƒদয় (২৫), তার হেলপার রাকিব হোসেন (২৩), দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান মো. রুবেল (২৮), আফরোজ মিয়া (৫০), ঠিকাদার কোম্পানির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের মালিক ইফতেখার হোসেন (৩৯), হেড অব অপারেশনস আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), ক্রেন সরবরাহকারী বিল্ড ট্রেড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন তুষার (৪২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) ও মঞ্জুরুল ইসলাম (২৯)।

মঈন বলেন, ‘এই ক্রেনের সক্ষমতা যাচাই করা উচিত ছিল যাদের, তারা সেটি করেননি। এ কারণে তাদের সবাইকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

ঘটনাস্থলের অদূরে দাঁড়িয়ে কাজ তদারকি করছিলেন চীনা কোম্পানি সিজিজিসির চীনা কর্মকর্তারা। তাহলে তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হলো নাÑএমন প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আমরা এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সবাইকেই ধরেছি। আপনারা যে কথাটি বলছেন, এখানে একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। মাঠের কর্মীরা যাদের কথা বলেছে, তাদের সবাইকেই ধরা হয়েছে।’

ওই ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিন। তার হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে ২ থেকে ৩টি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার পর গত মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। আর তার সহকারী রাকিব তিন মাস আগে ওই প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। তার ক্রেন চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ নেই।