নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং ইউএসএআইডি যৌথভাবে আয়োজিত ‘পাট হতে পরিবেশবান্ধব পাল্প ও কাগজ প্রস্তুত’ বিষয়ক সেমিনার গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। সেমিনারে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলে ওয়াহিদ খন্দকার বিশেষ অতিথি ছিলেন। এতে পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে এর বহুমুখী ব্যবহারের ওপর জোর দেন বক্তারা।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেছেন, পাট খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখছে। তিনি বলেন, একসময় বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট খাত এবং পাটকে সোনালি আঁশ বিবেচনা করা হতো। ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি পাট হতে পাল্প ও পেপার উৎপাদনে মনোযোগী হলে, আমরা আবারও পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে পারি। তিনি এ লক্ষ্যে পাট খাতে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও আর্থিক সহায়তা দানে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাসেম খান জানান, সারা পৃথিবীতে উৎপাদিত পাটের ৩৩ শতাংশ বাংলাদেশ উৎপন্ন করে এবং কাঁচা পাটের মোট রফতানির ৯৪ শতাংশ সারা পৃথিবীতে রফতানি করে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে পাট থেকে পাল্পের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ হাজার টন, যার চাহিদা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ডিসিসিআই সভাপতি পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন নতুন চাষাবাদ পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার আবিষ্কারের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম আরও বৃদ্ধির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, বর্তমান সরকার পাট খাতের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরে পেতে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, দেশবাসীকে পাট ও পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ৬ মার্চ ‘জাতীয় পাট দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে সারা দেশব্যাপী তা পালিত হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের মাত্র ১০ শতাংশ বীজ আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে থাকি, বাকি ৯০ শতাংশ বীজের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল, তাই পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার পাটচাষিদের পাটের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার পাশাপাশি পাটচাষি এবং এ খাতের ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, যা শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে।
পাট প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশে বর্তমানে ৮৫ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হচ্ছে এবং এটাকে এক কোটি বেলে উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সারা দেশে বিজেএমসি’র আওতাধীন পাটকলগুলোর অব্যবহƒত জায়গায় বস্ত্র ও পাট বিষয়ক শিল্প-কারখানা স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোক্তারা আগ্রহ প্রকাশ করলে সরকার জায়গা বরাদ্দের পাশাপাশি সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে।
তিনি বলেন, বিজেএমসি’র মাধ্যমে দেশে প্রথমবারে মতো পাট থেকে পরিবেশবান্ধব পাল্প ও কাগজ উৎপাদনের শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হবে। তিনি আরও জানান, সরকার কাঁচা পাট থেকে পলিমার ব্যাগ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং এটি ব্যবহারে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত হবে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলে ওয়াহিদ খন্দকার বলেন, বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে পাটের চাষ বেশি হয়, সেখানে পাল্প ও কাগজ প্রস্তুতকারী কারখানা স্থাপন করতে হবে, যার মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পাট থেকে পাল্প ও পেপার প্রস্তুতে পাটচাষি ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা সম্ভব হবে। তিনি বছরে দুবার পাটচাষে পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য বিজেআরআই’র গবেষকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি পাট চাষি, গবেষক এবং এ খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আরও সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)-এর মহাপরিচালক ড. মো. মনজুরুল আলম, ডিসিসিআই’র আহ্বায়ক রাশেদুল করীম মুন্না এবং বিজেএমসি’র সাবেক যুগ্ম সচিব ও পরিচালক বাবুল চন্দ্র রয় অংশগ্রহণ করেন। বিজেআরআই’র মহাপরিচালক ড. মো. মনজুরুল আলাম বলেন, গাছ থেকে কাগজ তৈরির মাধ্যমে সারা পৃথিবীতেই বন ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে, যার ফল হিসেবে পাট থেকে পাল্প ও পেপার তৈরির বিষয়ে সবার আগ্রহ বেড়েছে। তিনি বছরে দুবার পাটচাষের জন্য বীজ ও প্রয়োজনীয় কার্যপ্রণালি আবিষ্কার এবং বিশেষ করে লবণাক্ত পানিতে পাটচাষের সম্ভাবনা যাচাইয়ের বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি দেশের টেক্সটাইল খাতে আরও বেশি করে পাট ব্যবহারের জন্য এ খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
ডিসিসিআই’র আহ্বায়ক রাশেদুল করীম মুন্না বলেন, সারা পৃথিবীতে পরিবেশবান্ধব পাটপণ্য ব্যবহারের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তাই আমাদের পাটপণ্য প্রসারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রান্ডিং আরও জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট থেকে আন্তর্জাতিক মানের পাল্প ও কাগজ প্রস্তুতে সম্ভব এবং এ ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার একান্ত আবশ্যক।
মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই পরিচালক ইমরান আহমেদ, খ. রাশেদুল আহসান, রিয়াদ হোসেন, সেলিম আকতার খান, সাবেক পরিচালক এ কে ডি খায়ের মোহাম্মদ খান, সোনালি আঁশ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক নাজিম আহমেদ, বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এনামুল হক পাটোয়ারী এবং ডিসিসিআই’র সদস্য নেয়ামত উল্লাহ মজুমদার অংশগ্রহণ করেন। আলোচকরা পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনে গবেষণা পরিচালনা, এ খাতের উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে আর্থিক সহায়তা প্রদান, সারা বিশ্বে বাংলাদেশি পাটপণ্যের প্রসারের লক্ষ্যে ব্রান্ডিং কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং পাটপণ্যের শিল্প-কারখানা স্থাপনে জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদানের বিষয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি কামরুল ইসলাম, এফসিএ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
ডিসিসিআই সহ-সভাপতি হোসেন এ সিকদার, পরিচালক আসিফ এ চৌধুরী, খ. রাশেদুল আহসান, সাবেক সহ-সভাপতি আবসার করিম চৌধুরী, সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম খান, এফসিএ এবং মহাসচিব এএইচএম রেজাউল কবির এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
Add Comment