সোনালীর ১০ শাখা রাঘব বোয়ালদের আস্তানা

জয়নাল আবেদিন: হাতে গোনা কয়েকটি শাখায় জিম্মি সোনালী ব্যাংকের বেশিরভাগ অর্থ। অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত শাখাগুলো। তার মধ্যে অন্যতম হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল করপোরেট শাখা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল করপোরেট শাখা সোনালী ব্যাংকের একটি সুপরিচিত শাখা। কারণ এ শাখার মাধ্যমেই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ছিল হলমার্ক গ্রুপ, যা এখনও ফেরত পায়নি ব্যাংক।

জানা গেছে, ব্যাংকের বড় বড় দুর্নীতিবাজদের বিচরণ এসব শাখায়ই বেশি। তার মধ্যে একটি হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে আলোচিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল করপোরেট শাখা। শীর্ষ ২০ খেলাপির দুই প্রতিষ্ঠানই ছিল এই শাখার গ্রাহক। প্রথমটি মেসার্স টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপ, যার খেলাপির পরিমাণ ৪৯০ কোটি টাকা। এ শাখার অন্য প্রতিষ্ঠান হলমার্ক গ্রুপ, যাদের খেলাপি ঋণ এখন ৪৮৪ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন থেকে খেলাপি হয়ে পড়ে থাকা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কোনোভাবেই টাকা আদায় করতে পারছে না সোনালী ব্যাংক। এখন আইনের আশ্রয় নিয়ে আদালত চত্বরে ঘুরছে ব্যাংকটি। ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান মিলে হলমার্কের পাওনা রয়েছে তিন হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা।

দুর্নীতিগ্রস্ত অন্য শাখাগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় কার্যালয়, রমনা করপোরেট শাখা, দিলকুশা করপোরেট, লালদীঘি শাখা, নারায়ণগঞ্জ করপোরেট, দৌলতপুর করপোরেট, খুলনা করপোরেট, আগ্রাবাদ করপোরেট ও ফরিদপুর করপোরেট শাখা।

তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির সবাই এই শাখাগুলোর গ্রাহক, যাদের সমন্বিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৮৩ কোটি টাকা। সুতরাং সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপির ৩৮ শতাংশ মাত্র ১০টি শাখার ‘অবদান’। 

পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় এসব খেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের আশা নেই বললেই চলে। ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ব্যাংকটির পাওনা অর্থ কোনোভাবেই আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েও পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে অনিয়ম কিছুটা কমে আসবে বলে মত বিশ্লেষকদের।

সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হল-মার্ক গ্রুপ। এর মধ্যে হল-মার্ক সংশ্লিষ্ট টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের কাছে খেলাপি ৪৯০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এছাড়া মেসার্স হল-মার্ক গ্রুপের কাছে খেলাপি ৪৮৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। তাইপে বাংলা ফেব্রিকসের কাছে পাওনা ৩৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। মেসার্স ফেয়ার অ্যান্ড ফেব্রিকসের খেলাপি ৩১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মেসার্স রহমান গ্রুপের কাছে ৩১৪ কোটি তিন লাখ টাকা, মেসার্স লীনা গ্রুপের কাছে বকেয়া ২১৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলসের কাছে ১৮২ কোটি টাকা, এফআর জুট ট্রেডিংয়ের কাছে ১৩১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ও মেসার্স মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের খেলাপি ১৩০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সোনালী জুট মিলের কাছে পাওনা ১২৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ কে জুট ট্রেডিংয়ের খেলাপি ১১৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ১১৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, মেসার্স এফ আর জুট মিলস ১১২ কোটি চার লাখ টাকা, আব্দুল রাজ্জাক লিমিটেডের কাছে বকেয়া ১০৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, মেসার্স সুপ্রিম জুট অ্যান্ড নিটেক্স লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ১০৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, মেসার্স ইস্টার্ন ট্রেডার্সের ৯২ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ফারুক ডাইং নিটিংয়ের ৯০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, মেসার্স সানবীম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ৮৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং শীর্ষ ২০ খেলাপিতে আছে মেসার্স সাইয়ান করপোরেশন। তাদের কাছে বকেয়া ৭৬ কোটি সাত লাখ টাকা।

সোনালী ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ বড় খেলাপি ঋণ আদায় আদালতে মামলা করা হয়েছে। তবে একদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অন্যদিকে খেলাপিরা বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে রাখে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না।

ব্যাংকটির তথ্য বলছে, চলতি বছরে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে দুই হাজার ২৩২ কোটি ৫০ লাখ আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করলেও আট মাসে লক্ষ্যের এক শতাংশ অর্থও আদায় করতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মাত্র দশমিক ৪৩ শতাংশ বা ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা আদায় করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সুভাস চন্দ্র (সিএফও) বলেন, করোনার কারণে এ বছর আদায় কিছুটা কম ছিল। শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের ডিএমডি ও জিএমদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তারা আবার জিএমদের নিয়ে আলাদা টিম করেছে। শিগগির আদায় হার বৃদ্ধি পাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন এই কর্মকর্তা।

অবলোপনকৃত ঋণ থেকে অর্থ আদায়েও ব্যর্থ সোনালী ব্যাংক। কারণ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মাত্র ২০ গ্রাহকের দুই হাজার ৭২৯ কোটি টাকা অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক। এর বিপরীতে গত আগস্ট পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ১৮ কোটি টাকা, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার সাত শতাংশের কাছাকাছি।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের এক হাজার ২২৯ কোটি টাকা অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক। তবে গত আট মাসে আদায় হয়নি এক টাকাও। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল করপোরেট শাখা থেকে জালিয়াতি হওয়া এসব টাকার পুরোটারই এখন আদায় অনিশ্চিত। নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স নিউ রাখি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ১২৩ কোটি টাকা অপলোপন করা হয়েছে। এর বিপরীতে কোনো টাকা ফেরত আসেনি। কাগজে-কলমে রয়ে গেছে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা। চলতি বছরে এই গ্রাহকের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সোনালী ব্যাংক। কিন্তু আট মাস পার হয়ে গেলেও আদায়ের তালিকা শূন্য।

এছাড়া আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স জাসমির ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের অবলোপনের পরিমাণ ১০৬ কোটি টাকা। ১০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও কোনো টাকা আদায় হয়নি এখন পর্যন্ত। একই অবস্থা ৯৬ কোটি টাকা অবলোপন করা রমনা করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স ফেয়ার এক্সপোতেও। শীর্ষ ২০ অবলোপনকৃত গ্রাহকের মধ্যে মেসার্স ইম্পেরিয়াল ডাইং অ্যান্ড হোসিয়ারি লিমিটেড এবং মেসার্স রিভারসাইড লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার লিমিটেড জমা করেছে নামমাত্র কিছু টাকা। বাকি ১৮ গ্রাহকের মধ্যে কেউই ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করেননি ব্যাংকের প্রতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব গ্রাহক কখনোই ব্যাংকের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। ব্যাংকের টাকা তছরুপ করার জন্যই ঋণ নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু বিষয়গুলো জানার পরেও কতিপয় অসাধু ব্যাংকার সহযোগিতা করেছেন। সে কারণেই টাকাগুলোর আদায় এখন অনিশ্চিত।

সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ অবলোপনকারীর মধ্যে এক টাকাও ফেরত না দেয়া গ্রাহকের তালিকায় আরও রয়েছে মেসার্স আলফা টোবাকো, মেসার্স ওয়ান স্পিনিং মিলস লিমিটেড, মেসার্স রোকেয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, মেসার্স সাহিল ফ্যাশন লিমিটেড, মেসার্স ইমাম ট্রেডার্স, মেসার্স সুমি’স সোয়েটার, মেসার্স ইউনিটি নিটওয়্যার, মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্স, মেসার্স কেপিএফ টেক্সটাইল, মেসার্স মুন নিটওয়্যার, মেসার্স এ আর খান সাইজিং অ্যান্ড ফেব্রিক্স, মেসার্স সাহিল নিটওয়্যার লিমিটেড, জাদু স্পিনিং মিলস লিমিটেড এবং মাস্ক সোয়েটার লিমিটেড।

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শুধু সোনালী নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চলছে। এখানে প্রভাবশালীদের চাপ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ কেলেঙ্কারি হচ্ছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব অনিয়মে সহযোগিতা করছেন। সুশাসনের অভাব, তেমন জবাবদিহিও করতে হয় না। প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না, আবার বিভিন্ন চাপে ব্যাংকের কিছু করারও থাকে না। এখন যে কোনো উপায়ে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে বলে পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাপ দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা লাগবে। একই সঙ্গে সুশাসন নিশ্চিত ও পর্ষদকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০