সাইমউল্লাহ সবুজ: পুঁজিবাজারে কাগজ ও মুদ্রণ খাতের কোম্পানি সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড। তালিকাভুক্তকরণের নিয়ম ভেঙে ২০২০ সালে কোম্পানিটিকে ওভার-দ্য-কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান বোর্ডে আবার তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি)। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ারদরে দেখা দেয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এক বছরের ব্যবধানে সোনালী পেপারের শেয়ারদর বেড়ে ৯০০ টাকায় উঠে যায়।
দরবৃদ্ধির এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটির স্পন্সর শেয়ারহোল্ডাররা কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে দরবৃদ্ধিতে মুনাফার আশায় শেয়ার কিনে উল্টো লোকসান গুনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ডিএসইর তথ্যমতে, সর্বশেষ গতকাল ২০ আগস্ট কোম্পানিটির শেয়ারদর ২১৩ টাকা ৩০ পয়সায় টাকায় নেমে আসে। এর আগের দিন ১৯ আগস্ট এ দর ছিল ২১৯ টাকা। প্রায় প্রতিদিনই কমছে শেয়ারটির দর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোম্পানিটি কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারদর বাড়িয়েছে। সোনালী পেপারের অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে আবুল খায়ের হিরু, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও সাবেক কমিশনার অধ্যাপক মিজানুর রহমান এবং কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ ও স্পন্সর শেয়ারহোল্ডাররাও সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় কোম্পানিটির অন্যতম ব্যবসা।
জানা যায়, কোম্পানিটিকে যেসব শর্তে আবার তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পরিচালকরা তাদের শেয়ার বিক্রি করতে পারবেন না এবং আবার তালিকাভুক্তির তিন বছরের মধ্যে রাইট শেয়ার ইস্যু করতে পারবেন না। কিন্তু মূল বাজারে ফেরার পর উভয় শর্তই লঙ্ঘন করে কোম্পানিটি। শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে কোম্পানির মালিকরা লক-ইন পিরিয়ড থেকে অব্যাহতি নিয়ে তাদের শেয়ার বিক্রি করেছেন। আবার মূলধন বাড়ানোর জন্য রাইট ইস্যু করে সে শেয়ার বিক্রি করে আরেক দফা অস্বাভাবিক মুনাফা করেছেন চেয়ারম্যান ও স্পন্সর শেয়ারহোল্ডাররা।
ডিএসই ওয়েবসাইট অনুসারে, কোম্পানিটি জুন ২০২১ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ১৬ মাসে ১৫ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছে। বাজারদরে বিক্রীত এসব শেয়ারের মূল্য ছিল প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে ২০২২ সালের ২০ এপ্রিলে রাইট শেয়ার ইস্যু করে কোম্পানিটিকে ১১ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন দেয় বিএসইসি।
সোনালী পেপারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে ব্যাপক সমালোচনার জš§ হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২০২০ এবং ২০২১ অর্থবছরের জন্য সোনালী পেপারের আর্থিক বিবরণী তদন্ত করতে একটি বিশেষ নিরীক্ষক নিযুক্ত করা হয়। বিএসইসি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করে এবং জুনে তারা চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়। জালিয়াতির প্রমাণ থাকার পরও কোম্পানির চেয়ারম্যান ও স্পন্সর শেয়ারহোল্ডারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম নিজেই সোনালী পেপারের পর্ষদের সঙ্গে যৌথভাবে এ কারসাজিতে জড়িত রয়েছেন। তাই তদন্তে ধরা পড়ার পরও তিনি বা কমিশন সোনালী পেপারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া মোহাম্মদ ইউসুছ নিজেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্ষমতার অপব্যবহার করেও তিনি নানা সুবিধা নেন।
জানা যায়, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার তালিকাভুক্তিকরণের সংশোধিত বিধিমালায় যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকার কম, তাদের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত না করার বিষয়ে বলা হয়। তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশন এই শর্ত পূরণ থেকে অব্যাহতি দিয়ে সোনালী পেপারের পুনঃতালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়। ডিএসইর তথ্য অনুসারে, সোনালী পেপারের পরিশোধিত মূলধন ২০১৯ সালে ১৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ছিল।
কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন আরেকটি ছাড়ও দিয়েছে। ফলে অবিলম্বে তিন আর্থিক বছরে নেট ইতিবাচক নগদ প্রবাহের নিয়ম মেনে চলতে হয়নি। কোম্পানিটি ২০১৭ ও ২০১৮ সালে লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল।
ডিএসই ২০০৯ সালের অক্টোবরে সোনালী পেপার ও বোর্ড মিলসসহ ৫১টি খারাপ পারফরম্যান্সকারী তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে ওটিসি মার্কেট চালু করে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটি ২০১১ সাল থেকে মূল বোর্ডে ফিরে আসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তালিকাভুক্তির নিয়ম না মেনে চলার কারণে ডিএসই বোর্ড কয়েকবার তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। অবশেষে কমিশন ২০২০ সালের জুলাই মাসে সোনালী পেপারকে মূল বোর্ডে ফিরে আসার অনুমতি দেয়, ন্যূনতম ৩০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের তালিকাভুক্তির নিয়মসহ কমপক্ষে ১৮টি ছাড় দেয়। তাছাড়া কাগজভিত্তিক প্যাকেজিং উৎপাদনকারী কোম্পানিকে মূল বোর্ডে আসার অনুমতি দেয়া হয়, যখন কোম্পানির আয়ের প্রধান উৎস ছিল শুধু পুঁজিবাজার থেকে আয়, যেখানে কোম্পানিটি নিয়ম লঙ্ঘন করে বিনিয়োগ করে। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত কোম্পানির পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ছিল ৫০ কোটি টাকা, যখন মূল্যের ইনভেন্টরি ২৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা টাকা, যা কোম্পানির মূল ব্যবসার চেয়ে বেশি শেয়ারে বিনিয়োগ প্রতিফলিত করে।
সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শেয়ার বিনিয়োগ থেকে আয় ছিল ১৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যার কর পূর্বে তার মোট নিট মুনাফার ৮৬ শতাংশ। কোম্পানিটি মূল ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ না ঘটলেও শেয়ার ব্যবসার ওপর ভর করে ২০২১ সালে ২০ শতাংশ নগদ ও ২০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ, ২০২২ সালে ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ এবং ২০২৩ সালে ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করে।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, কোম্পানিটি মূল বাজারে পুনঃতালিকাভুক্তিকরণে তৎকালীন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানিটিকে প্রয়োজনীয় শর্তসাপেক্ষে তখন মূল বাজারে পুনঃতালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সোনালী পেপারের অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোম্পানিটির শেয়ারদরে অসংগতি দেখা দিলে কারণ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।