মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাত দখল করে রাখার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে। সৌন্দর্যবর্ধনের আড়ালে ফুটপাতের ওপর তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা, যদিও এ স্থাপনা নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছে খোদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এতে বন্ধ হয়ে গেছে পথচারীদের হাঁটার রাস্তা। ফলে ফুটপাত না পেয়ে পথচারীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া ফুটপাতে হোটেল ও রান্নাঘর স্থাপন করায় নোংরা হচ্ছে ওই এলাকার পরিবেশও। প্রতিদিনই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট।
জানা যায়, নগরীর ওআর নিজাম রোডের প্রবর্তক মোড় থেকে পাঁচলাইশ পর্যন্ত অংশে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য গত বছরের অক্টোবরে ‘গ্রিড এ ওয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চসিক। এ প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সুদীপ বসাকের চাচাতো ভাই সুমন বসাক। কাজ শেষে ওই বছরের ডিসেম্বরে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন তা উদ্বোধন করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি যতটা না সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ফুটপাত দখল করে রেখেছে। আর এতে সম্মতি দিয়েছেন খোদ চসিকেরই পরিকল্পনা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রবর্তক মোড় থেকে পূর্ব দিকে সামান্য অগ্রসর হলেই বাঁ পাশে শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অপর পাশে, অর্থাৎ সড়কের ডান পাশে রয়েছে মক্কী মসজিদ। মসজিদটির পশ্চিম পাশের ফুটপাতে বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি দোকান। রাস্তাঘেঁষে নির্মাণ করা দোকান দুটির একটি হচ্ছে ‘ফ্রেশ ফুড’ নামে রেস্টুরেন্ট। আরেকটি হচ্ছে ‘শ্রেষ্ঠা মেডিসিন’ নামের ওষুধের দোকান। এছাড়া করা হয়েছে একটি ভ্রাম্যমাণ পান-বিড়ির দোকান। বাণিজ্যিক এ প্রতিষ্ঠান তিনটিকে বৈধতা দিতেই দু’পাশে সামান্য ফুলের টব লাগিয়েছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিড এ ওয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং’।
রেস্টুরেন্টটিতে রান্নার কাজে ব্যবহার হওয়া গ্যাসসিলিন্ডার দোকানের পশ্চিম পাশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাখা হয়েছে। হাঁটার জন্য রাখা সামান্য পরিমাণ ফুটপাতও ব্যবহার করছে দোকানটি। সেখানে রাখা হয়েছে দোকানের পণ্যসামগ্রী। পথচারীরা হাঁটার জন্য ব্যবহার করছেন রাস্তা। তারা বলছেন, ‘যতটুকু অংশ সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি অংশজুড়েই আছে দোকান।’ ফলের টব লাগানো অংশ ময়লায় ভরে গেছে। সেখানে রাখা হয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ভগ্নাংশ।
জানা যায়, একসময় এ এলাকায় শুধু শেভরন ডায়গনস্টিক ছিল। বর্তমানে এটি শেভরন হাসপাতাল হয়েছে। এছাড়া এখানেই হচ্ছে বেলভিউ হাসপাতাল। মসজিদের পাশে আছে নিবেদিতা হাসপাতাল। এ এলাকাটি এমনিতেই খুব সংকীর্ণ। মক্কী মসজিদের রাস্তাটি খুবই সংকীর্ণ। আর ফুটপাত নেই বললেই চলে। যেখানে দোকান স্থাপন করা হয়েছে, তার বিপরীতে পাশে ফুটপাত নেই। এ অবস্থায় হাঁটার যে জায়গা ছিল, সৌন্দর্যবর্ধনের নামে তাও দখল করা হয়েছে।
ফুটপাতের ওপর রেস্টুরেন্ট, রান্নাঘর ও ওষুধের দোকান নির্মাণ করায় ক্ষুব্ধ ওই এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী।
এলাকার মানুষ বলছেন, ‘দুপাশে ১৫ শতাংশ করে সৌন্দর্যবর্ধন করে মাঝখানের ৭০ শতাংশ জায়গা দখল করা হয়েছে। এ অংশে এমনিতেই যানজট লেগে থাকে। তার ওপর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাতের ওপর দোকানঘর স্থাপন করা হয়েছে। এতে চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। দোকানের পাশে রাখা হয় গ্যাসসিলিন্ডার। এর ফলে পথচারীদের জীবনে হুমকি বেড়েছে। যে কোনো সময় বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর দায় কে নেবে?
জানা যায়, রাস্তার পাশের ফুটপাতের যে জায়গায় দোকান নির্মাণ করা হয়েছে, তার পেছনে এক বছর আগে একটি বাড়ি ছিল। সংস্কার করার জন্য ওই বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। এখন ফুটপাতের স্থাপনা নির্মাণ করায় ওই প্লটের মালিকের আসা-যাওয়ার রাস্তাটিও বন্ধ রয়েছে। এ ব্যাপারে মেয়র বরাবর অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি প্লট মালিক।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘হোটেল তৈরি করায় পাঁচলাইশ সোসাইটি এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ফুটপাত না থাকায় হাঁটতে মহিলাদের খুব কষ্ট হয়। সৌন্দর্যবর্ধন কেমনে হলো? চলাফেরার জায়গা কোথায়? রেস্টুরেন্টের লোকজন যে সামান্য ফুটপাত আছে, তাতেই দাঁড়িয়ে থাকে, কাজ করে, আড্ডা দেয়। এতে জনস্বার্থ রক্ষা হলো কীভাবে? চসিকের এক প্রকৌশলীর স্বার্থ সংরক্ষণ হয়েছে। জনগণের ক্ষতি করে অন্যজনের পুনর্বাসন কীভাবে করলেন নগরপিতা? এ এলাকায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এখন টিনশেড দিয়ে হোটেল, হোটেলের জন্য রান্নাঘর করায় শহর নোংরা হচ্ছে।’
জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রবর্তক মোড় থেকে পাঁচলাইশ পর্যন্ত পুরোটাই সৌন্দর্যের আওতায় নিয়ে আসার কথা থাকলেও তা করেনি ‘গ্রিড এ ওয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং’।
ফুটপাত দখল করে স্থাপনা নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘গ্রিড এ ওয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর স্বত্বাধিকারী সুমন বসাক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমাকে কাজটা দেওয়া হয়েছে। মেয়র উদ্বোধন করেছেন। এখন ফুটপাত দখলের কথা কেন বলছেন? এটা সিটি করপোরেশনকে জিজ্ঞেস করুন।’
ফুটপাত দখল নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য নেইÑএ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আগে সেখানে কিছু ছিল না। মাদকের হাট ছিল। খুনখারাপি হতো। আমরা সেখানে সৌন্দর্যবর্ধন করেছি। এখন মানুষ দাঁড়ানোর জায়গা পাচ্ছে।’ এছাড়া জায়গা নিয়ে বিভিন্নজনের আপত্তির কারণে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ পুরোপুরি শেষ করা যাচ্ছে না বলে জানান সুমন বসাক।
পাঁচলাইশে সৌন্দর্যবর্ধন কাজে চুক্তি ভঙ্গ, ফুটপাত দখল বা কোনো ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান চসিকের প্রধান পরিকল্পনাবিদ একেএম রেজাউল করিম।
এ প্রসঙ্গে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘ওই জায়গাটি পরিত্যক্ত ছিল। ইয়াবা, ফেনিসিডিল ও গাঁজা বিক্রি করা হতো সেখানে। রিকশা, টেম্পো ও ভ্যানের স্ট্যান্ড ছিল। এখন সেগুলো দূর হয়েছে। ফুটপাত বা হাঁটার জায়গা ছিল না। এখন সৌন্দর্যবর্ধন করে ফুটপাত করা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে সেবা নিতে আসা মানুষও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনতে পারছেন। আগের ও বর্তমানের অবস্থা তুলনা করুন। রাতারাতি কোনো কিছু পরিবর্তন হয়নি।’