Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 9:02 pm

সৌরবিদ্যুতে ডলার ও জমি দখলের প্রতিযোগিতা!

বিদ্যুৎ খাতে গত দেড় দশকে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যদিও এসব অভিযোগ কখনোই তদন্ত করা হয়নি। বরং দায়মুক্তি আইনে দুর্নীতিবাজদের সব ধরনের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির প্রক্রিয়া ও কার্যকারণ উন্মোচনে সম্প্রতি অনুসন্ধান চালায় শেয়ার বিজ। এর ভিত্তিতে আজ থাকছে ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: কয়েক বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য উৎস তথা সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে জোর দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তবে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মতোই উচ্চ ব্যয়ে ও ডলারে চুক্তি করা হয় এসব সৌরবিদ্যুৎ কেনায়। ডলারের বিনিময় হার বাড়তে থাকায় সৌরবিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় প্রতি বছর বাড়ছে। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হলেও ফুলে-ফেঁপে উঠছে কোম্পানি।

যদিও ডলার পকেটে পুরেই ক্ষান্ত হয়নি কোম্পানিগুলো, বরং সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে জমি দখল ও তিন ফসলি জমি নষ্ট করার প্রতিযোগিতায় নামে এরা। আর সৌরবিদ্যুতে এ সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হননি আওয়ামী লীগ নেতারা। শুরুর দিকে দু-তিনটি বিদেশি কোম্পানি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এগিয়ে এলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা (এমপি) এ ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিকল্পনাধীনভাবে ও দরপত্র ছাড়াই রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মতো সৌরবিদ্যুতের লাইসেন্স দেয়া হয়। ফলে প্রকৃতপক্ষে এ খাতে কত ব্যয় হতে পারে তার নির্দিষ্ট কোনো ফরম্যাট নেই। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন সময় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে আসে। তখন তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে নির্মাণব্যয় ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো নানাভাবে তদবির করে সরকারি ও বিদেশি কোম্পানির চেয়ে বেশি রেট নিয়ে গেছে।

সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি পড়ছে। ২০২৩ সালে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ প্রকাশিত ‘ফলো দ্য রিনিউয়েবল এনার্জি ফাইন্যান্স: বাংলাদেশ পার্সপেকটিভ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের গড় ব্যয় পড়ছে ১৫ দশমিক ৫ ইউএস সেন্ট। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ হার ৫ দশমিক ৩ সেন্ট ও পাকিস্তানে ৩ দশমিক ২ সেন্ট। এছাড়া ভিয়েতনামে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদনের গড় ব্যয় ৮ দশমিক ৪ সেন্ট, জাপানে ৯ দশমিক ৩ সেন্ট ও থাইল্যান্ডে ১২ দশমিক ১ সেন্ট।

এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে নির্মিত বা নির্মাণাধীন বিভিন্ন কেন্দ্রে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় ধরা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ১১ থেকে ১৭ সেন্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে সুনামগঞ্জে নির্মাণাধীন হাওর বাংলা সোলার পার্কে। এ কেন্দ্রটি থেকে সৌরবিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ সেন্ট। আর লালমনিরহাটের ইন্ট্রাকো সোলার পার্ক থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ সেন্ট এবং গাইবান্ধায় বেক্সিমকোর সোলার পার্ক থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ সেন্ট।
যদিও বিদেশি মালিকানাধীন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে সৌরবিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় অনেক কম ধরা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় নির্মাণাধীন গ্রিড সোলার প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪৮ সেন্ট। অর্থাৎ বিদেশি কোম্পানির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির সৌরবিদ্যুৎ কিনছে সরকার। এছাড়া ডলারের চুক্তির ফলে দেশীয় মুদ্রায় অবমূল্যায়নে এ খাতে ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে নবায়নযোগ্য উৎস তথা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪৭৪ মেগাওয়াট। সে বছর এ খাত জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ১৫ টাকা ৭৭ পয়সা। ২০২৩-২৪ অর্থবছর নবায়নযোগ্য উৎস তথা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা একই ছিল। গত অর্থবছর এ খাত জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ৮০ কোটি ৯১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ৫৯ পয়সা। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন বাড়লেও গড় ব্যয় কমেনি। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছর সৌরবিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ১২ টাকা ৮৫ পয়সা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডলারে সৌরবিদ্যুৎ কেনার সরকারি সিদ্ধান্তে এ খাতের মুনাফায় চোখ পড়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের। গত দুই বছরে ২৭টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এক হাজার ৩৬০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের অধিকাংশই সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি। তাদের মধ্যে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর বাইরে শরীয়তপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাকের একটি, বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) সাবেক পরিচালক জালাল ইউনুসের একটি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের একটি, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ছোট ভাইয়ের একটি, খুলনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সালামের একটি, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের একটি, টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্যা তানভীর হাসানের (ছোট মনি) একটি, সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুর রহমানের একটি, সিলেটের হাবিবুর রহমান এমপির একটি এবং রাজশাহী অঞ্চলের এক এমপির একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।

এদিকে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ বা দখল করা হয়েছে অনেক জায়গায়। গত বছর পাবনা, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটের তিনটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যবেক্ষণ শেষে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানায়, পাবনার হেমায়েতপুরে ৪০০ একর জমিতে প্যারামাউন্ট গ্রুপের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত, যেখানে মোট জমির ২৫ শতাংশ সরকারি খাসজমি। আর জমি কেনার আগেই জোর করে জমি দখল নিয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের পাহারায় বসানো হয়। এছাড়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও ৩০ শতাংশ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাননি। এ কেন্দ্রটির ট্যারিফ ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৯০ ইউএস সেন্ট।

সংস্থাটি আরও জানায়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ৬০০ একর জমিতে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করেছে বেক্সিমকো লিমিটেড। সেখানে বিদ্যুতের ট্যারিফ ধরা হয়েছে ১৫ সেন্ট। তবে প্রকল্পটিতে ধ্বংস করা হয়েছে তিন ফসলি জমি। ভুয়া মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে কৃষকদের। বর্গাচাষি ও দিনমজুররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। একই সঙ্গে স্থানীয়রা অঞ্চল ছাড়ায় বেড়েছে বাস্তুহারার সংখ্যা। অপর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে ক্যাব জানায়, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে ১২০ একর জমির ওপর সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে ইন্ট্রাকো পাওয়ার লিমিটেড। কিন্তু প্রকল্পটির দখলে আছে ৩০০ একর জমি, যা কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে দখল করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিস্তা নদীর দুই কিলোমিটার ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে সড়ক। নদীর ধারে রাস্তা তৈরিতে আশপাশে এলাকায় তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। প্রকল্পটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে হওয়ায় বিদ্যালয়ের পরিবেশেও প্রভাব পড়েছে। ওই কেন্দ্রটির বিদ্যুতের ট্যারিফ ধরা হয়েছে ১৬ সেন্ট।

এর বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় কৃষকদের প্রায় ৭৫০ একর জমি দখল করে সেখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালুর অভিযোগ করেছেন স্থানীয় কৃষকেরা। কৃষকদের দাবি, প্রভাবশালী একটি মহল কৃষকদের জমি দখল করে প্রভাব খাটিয়ে বগুড়া জেলার ধরাবর্ষা মৌজার একাংশ ও জামালপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করে কাইজার চর নামে ভুয়া মৌজা তৈরি করে খাস খতিয়ানে এনে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে সান পাওয়ার লিমিটেড এবং এমএ গ্রীন নামে দুটি সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির বিরুদ্ধে স্থানীয়দের জমি দখল ও জালিয়াতির মাধ্যমে জমি কেনার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, কোম্পানি দুটি উপজেলার শিমুলবাড়ী ও বড়ভিটা ইউনিয়নে সোলার গ্রিড স্থাপনের কাজ করছে। তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে তিন ফসলি জমি দখল করছে, নামে-বেনামে ভুয়া দলিল তৈরি করে নিরীহ কৃষকদের জমি দখল করছে। যারা জমি বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে না, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে তাদের জমি দখলের পাঁয়তারা করছে। ভুক্তভোগী কৃষক ও এলাকাবাসী এর প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের পুলিশি হয়রানি করা হচ্ছে।

একইভাবে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে ১৮০ একর জমিতে ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘সাইক্লেক্ট এনার্জি পিটিই লিমিটেড’। ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহলের বিরুদ্ধে জমি বিক্রির জন্য মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। ফসলি জমিতে প্রকল্প স্থাপনে আপত্তি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। গ্রামবাসীর দাবি, প্রকল্পের জন্য যে জমি নির্বাচন করা হয়েছে, তা সবই তিন ফসলি। সেখানে প্রকল্প স্থাপন করলে কৃষির ওপর নির্ভরশীল গ্রামের তিন হাজারেরও বেশি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন।