ইসমাইল আলী: দেশে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ২০ বছর মেয়াদি অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন করেছে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)। ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি অ্যাকশন প্ল্যান, ২০২১-২০৪১’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনটি গত আগস্টে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে আগামী ২০ বছরে ৩০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি। বরং প্রতিবেদনটি নিয়ে লুকোচুরি করছে স্রেডা।
অভিযোগ রয়েছে, কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে এবং বিদ্যুৎ খাতের মাস্টার প্ল্যানে সৌরবিদ্যুতের অংশ কমিয়ে দেখাতে প্রতিবেদনটিতে গোপনে চলছে নানা কাটছাঁট। তাই কবে নাগাদ এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে, তা নিশ্চিত নয়।
‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি অ্যাকশন প্ল্যান, ২০২১-২০৪১’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি ইউএনডিপির সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে স্রেডা। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি শেয়ার বিজের হাতে এসেছে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এক হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাাত্রা নির্ধারণ করেছিল স্রেডা। যদিও গত জুলাই পর্যন্ত মাত্র ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে এ খাত থেকে।
অ্যাকশন প্ল্যানে তিনটি চিত্র বিশ্লেষণ করে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বেজ কেস তথা বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সাল নাগাদ আট হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তবে গতি কিছুটা বাড়ালে মাঝারি কেস তথা মধ্য গতিতে ২০৪১ সাল নাগাদ ২০ হাজার মেগওয়াট বিদ্যুৎ সৌর খাত থেকে আসার সুযোগ রয়েছে। আর উচ্চ কেস তথা সর্বোচ্চ গতি প্রয়োগ করলে ২০৪১ সালে সৌরবিদ্যুৎ থেকে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান, ২০১৬-তে বলা হয়েছে, ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা দাঁড়াবে ৮২ হাজার ২৯২ মেগাওয়াট। তা পূরণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা লাগবে ৯৪ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ২০৪১ সালে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ সৌরবিদ্যুৎ থেকে পূরণ করা সম্ভব।
যদিও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাহিদা না বাড়ায় মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ৬০ মেগাওয়াটে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে অর্ধেকই এ খাত থেকে পাওয়া যাবে।
সোলার এনার্জি অ্যাকশন প্ল্যানে দেখা যায়, ২০৪১ সালে সোলার পাওয়ার হাব থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট, সোলার পিভি পাওয়ার বাই ইউলিটিজ থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট, সোলার পিভি পাওয়ার বাই আইপিপি’স থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট, রুফটপ সোলার থ্রো এনইএম থেকে চার হাজার মেগাওয়াট, সোলার ইরিগ্রেশন পাম্প থেকে দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, সোলার হোম থেকে ২৮৫ মেগাওয়াট, সোলার চার্জিং স্টেশন থেকে ১০১ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য খাত থেকে ১১৪ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
২০২০ সাল পর্যন্ত ৫৬৯ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ থেকে আসবে। ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আট হাজার ৩১৫ মেগাওয়াট এবং ২০৩১ সাল থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে ২১ হাজার ১১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌর খাত থেকে উৎপাদন করা হবে।
সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে জলবায়ু অর্থায়ন ও পরিবেশ বিশ্লেষক এম জাকির হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে- সৌরবিদ্যুৎ খাত থেকে ৩০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সম্ভব। শুধু ৩০ হাজার মেগাওয়াট নয়, বরং আরও বেশি বিদ্যুৎ এ খাত থেকে উৎপাদন সম্ভব। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল জোগাতে একইসঙ্গে সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে অনুদানের পাশাপাশি বিনিয়োগের সুরক্ষা এবং আর্কষণীয় প্রণোদনা প্রদান করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কয়লা থেকে সরে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে এলএনজির দিকে যাচ্ছে। এটি একদিকে ব্যয়বহুল, অন্যদিক পরিবেশবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত। এছাড়া এলএনজির জন্য বিদেশ নির্ভরশীলতা বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়ও হবে। এছাড়া বর্তমান সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও সংবিধানেও নিরাপদ জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। পেরিস চুক্তি স্বাক্ষরকারী হিসেবেও সরকারের এটি বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা না করে প্রাণ-পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পথে হাঁটা কখনোই উচিত হবে না।
অ্যাকশন প্ল্যানের তথ্যমতে, বেজ কেইস অবস্থাতে ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দুই হাজার ৭৬ মেগাওয়াট ও ২০৩১ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৫৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সোলার পাওয়ার হাব থেকে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, সোলার পিভি পাওয়ার বাই ইউলিটিজ থেকে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, সোলার পিভি পাওয়ার বাই আইপিপি’স থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট, রূপটপ সোলার থ্রো এনইএম থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট, সোলার ইরিগ্রেশন পাম্প থেকে ৬০৫ মেগাওয়াট, সোলার হোম থেকে ২৮০ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য খাত থেকে ১১৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
এদিকে মাঝারি কেইস অবস্থাতে ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ হাজার ২৬৭ মেগাওয়াট ও ২০৩১ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে ১৪ হাজার ১৬৪ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সোলার পাওয়ার হাব থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট, সোলার পিভি পাওয়ার বাই ইউলিটিজ থেকে দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াট, সোলার পিভি পাওয়ার বাই আইপিপি’স থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট, রূপটপ সোলার থ্রো এনইএম থেকে দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, সোলার ইরিগ্রেশন পাম্প থেকে এক হাজার ৮৭৩ মেগাওয়াট, সোলার হোম থেকে ২৮০ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য খাত থেকে ১৪৭ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অ্যাকশন প্ল্যানটি কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না- জানতে চাইলে স্রেডার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, অ্যাকশন প্ল্যানটি প্রকাশে কোনো তাড়া নেই। এটির বিষয়ে নানা পক্ষের মতামত এসেছে। সেগুলো যুক্ত করতে পরামর্শককে বলা হয়েছে। সবগুলো একসঙ্গে যুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। এখানে লুকোচুরির কিছু নেই।
অ্যাকশন প্ল্যানে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ দ্রুত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে চীন ৩০ দশমিক ১০ গিগাওয়াট, যুক্তরাষ্ট্র ১৩ দশমিক ৩০ গিগাওয়াট, ভারত ৯ দশমিক ৯০ গিগাওয়াট, জাপান সাত গিগাওয়াট ও ভিয়েতনাম চার দশমিক ৮০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন ব্যয় কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০১০ সালে প্রতি কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন ব্যয় ছিল চার হাজার ৭০২ ডলার। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯৯৫ ডলার। এর প্রভাবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও অনেক কমে গেছে। ২০১০ সালে প্রতি কিলোওয়াটঘণ্টা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় ছিল ৩৮ সেন্ট। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে সাত সেন্ট।