Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 3:59 pm

স্কুল ব্যাংকিংয়ে সঞ্চয় শিক্ষার বিপরীতে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ

মো. জিল্লুর রহমান: প্রবাদ আছে, অর্থই অনর্থের মূল এবং এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থী অর্থের কারণে বখাটে হয়ে যায়। আর সময়মতো সঞ্চয় না করলে ভবিষ্যৎ অনেক সময় তাদের কাছে অন্ধকার মনে হয়। অর্থাভাবে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া যায় না, কখনও লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। যেহেতু সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে স্কুল ব্যাংকিং খোলার সুযোগ আছে, তাই শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়া যাবে, কেননা শিক্ষার্থীদের আজকের সঞ্চয় ভবিষ্যতের সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ এবং আগামী দিনের সোনালি সোপানের ভিত্তি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু গড়ে তোলে সিন্ধুÑএ কথাটা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে চরম সত্য।

কোমলমতি স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জন্য যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, তা-ই মূলত স্কুল ব্যাংকিং। এ হিসাব থেকে কোনো চার্জ কাটা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে স্কুল ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে। স্কুল ব্যাংকিংয়ে যারা টার্গেট গ্রুপ ১১ থেকে ১৭ বছরের ছাত্রছাত্রী, তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। তারা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে উপহার বা নগদ অর্থ পেয়ে থাকে, অথবা নিয়মিতভাবে দুপুরের টিফিন বাবদ যে অর্থ পেয়ে থাকে, তা থেকে কিছু কিছু অর্থ বাঁচে। এসব অর্থ জমা রাখার নিমিত্তে স্কুলের কাছের ব্যাংক শাখায় একটি সেভিংস হিসাব খোলার উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করাই স্কুল ব্যাংকিংয়ের উদ্দেশ্য।

প্রকৃতপক্ষে ছেলেমেয়েদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সঞ্চয় করার মনোভাব ও অভ্যাস গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস স্কুল ব্যাংকিং। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কুল ব্যাংকিং প্রচলিত আছে। কমনওয়েলেথ স্কুল ব্যাংকিং, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে স্কুল ব্যাংকিং একটি জনপ্রিয় সঞ্চয় বৃদ্ধির উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের খরচ কমানোর মাধ্যমে সঞ্চয় করার অভ্যাস গড়ে তোলার নিমিত্তে এ ধরনের ব্যাংকিংয়ের শুরু হয়েছে।

এর মাধ্যমে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা ছেলেবেলা থেকেই ব্যাংক হিসাব খোলার নিয়ম-কানুন এবং হিসাব পরিচালনায় দক্ষতা ও অভ্যাস গড়ে তুলতে পারদর্শী হবে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকে জমা রেখে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তুলবে এবং নিয়মিত ব্যাংকে আসা-যাওয়া এবকং টাকা জমা ও উত্তোলন করতে করতে একসময় দেখা যাবে, সংশ্লিষ্টদের হিসাবে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে, যা টিফিনের পয়সায় বা গুরুজনদের দেয়া উপহারের বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। আর এর মাধ্যমে সঞ্চয়ের যে অভ্যাস গড়ে উঠবে, তা সারাজীবন সুফল দেবে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের সেবা পৌঁছে গেছে সারাদেশের প্রায় সবখানে।

বর্তমানে আমাদের দেশের সব তফসিলি ব্যাংকে এই স্টুডেন্ট ব্যাংকিং স্কিম চালু রয়েছে। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে আছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করতে গ্রাহককে কোনো না কোনো চার্জ দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের এই হিসাব চালাতে কোনো খরচ দিতে হয় না। চেকবই নিতে গুনতে হয় না কোনো মাশুল। জমা বই, ডেবিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য সুবিধা তো আছেই। লেনদেন করা যায় যত খুশি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জন্য স্কুল ব্যাংকিংয়ের আমানত মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী আমানত, যা স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগযোগ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ে ২৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৩ শিক্ষার্থীর হিসাব খোলা হয়েছে এবং এর বিপরীতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২০৫ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থীদের আছে এক হাজার ২০২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা এবং মেয়েদের এক হাজার তিন কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যার মধ্যে ৫২ শতাংশ হিসাব শহরাঞ্চলে এবং ৪৮ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে। এ সময়ে গ্রামীণ পর্যায়ে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে হিসাব বেড়েছে এক দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে শহরে ছয় দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ কমেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও এখন ব্যাংকমুখী হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা তৈরি করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংক খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, স্কুল ব্যাংকিংয়ে ৫৪ শতাংশ ছেলে ও ৪৬ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীর হিসাব রয়েছে এবং আমানতের দিক থেকে ৫৪ দশমিক ৫১ শতাংশ ছেলে ও ৪৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ মেয়ে। এই প্রান্তিকে ছেলে ও মেয়ের হিসাব বৃদ্ধি যথাক্রমে ৩ দশমিক ১২ শতাংশ ও ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। একই সময়ে আমানত বেড়েছে ১ দশমিক ২৯ শতাংশ ও ২ দশমিক ৩১ শতাংশ হারে।

কোমলমতি স্কুলশিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং সুবিধা ও তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবার সঙ্গে পরিচিতি করানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের ২ নভেম্বর স্কুল ব্যাংকিং বিষয়ে একটি পরিপত্র জারি করে। এর পর থেকেই স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় মুনাফার নানা স্কিম চালু করে। ২০১০ সালে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বছরে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয় ২৯ হাজার ৮০টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় দেশের ব্যাংকগুলোয় মোট এক লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি হিসাব খোলা হয়। ওই সময় হিসাবগুলোয় মোট স্থিতি ছিল ৯৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ে ২৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৩ শিক্ষার্থীর হিসাব খোলা হয়েছে এবং এর বিপরীতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২০৫ কোটি টাকার বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, কভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। পাশাপাশি গত দুই বছরে ১৮ বছর অতিক্রম করেছে অনেক শিক্ষার্থী। এছাড়া মহামারির অভিঘাতে অনেক পরিবারের উপার্জন কমে যাওয়ার জন্যও স্কুল ব্যাংকিংয়ে একটি বড় প্রভাব পড়েছে। এ কারণে শহরের স্কুলগুলোয় ব্যাংকিং কমলেও গ্রামে বেড়েছে। ২০২১ সালে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব ও আমানতের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। মোট হিসাব নম্বরের ২৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ এই বিভাগে, যা মোট আমানতের ৪৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। এছাড়া চট্টগ্রামে হিসাব রয়েছে ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ, যার হিসাব সংখ্যা (ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪১টি) ও আমানত রয়েছে ২৩ দশমিক  শূন্য চার শতাংশ, যার টাকার পরিমাণ ৫০৮ কোটি ২৮ লাখ।

স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ। ফলে ব্যাংকগুলোতে এ কার্যক্রমের আওতায় খোলা হিসাবের পাশাপাশি আমানতের পরিমাণও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, স্কুল ব্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বেশি হিসাব ও আমানত রয়েছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট হিসাবের ৬৮ দশমিক ২০ শতাংশ হিসাব রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসাব রয়েছে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। স্কুল ব্যাংকিং হিসাবে এগিয়ে থাকা পাঁচটির প্রথম রয়েছে বেসরকারি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, যাতে হিসাব রয়েছে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৫৩৭; এরপর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, যার হিসাবসংখ্যা তিন লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০টি; অগ্রণী ব্যাংকে হিসাবসংখ্যা দুই লাখ ৬৩ হাজার ৪১১টি, ব্যাংক এশিয়ায় হিসাবসংখ্যা এক লাখ ৯২ হাজার ৯৬৬টি, সর্বশেষ রয়েছে রূপালী ব্যাংক, যাদের হিসাবসংখ্যা এক লাখ ৬৬ হাজার ২৩৬টি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ২০১০ সালে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেন। তবে শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। ২০১১ সালে ১০ টাকা দিয়ে হিসাব খোলা হলেও পরে হিসাব খুলতে ১০০ টাকা জমা রাখতে বলা হয়। এসব হিসাব সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে রূপান্তরের সুযোগও আছে।

‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল…’ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে এ কথাটি চরম সত্য। সঞ্চয় হচ্ছে ভবিষ্যতের মাপকাঠি, স্বপ্নের সিঁড়ি ও চরম বিপদের বন্ধু। ভবিষ্যতে বৃদ্ধ বয়সে অবসনকালে আরাম-আয়েশ করা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বিয়েশাদি বা হঠাৎ অসুস্থ হলে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো প্রভৃতি প্রয়োজনে সঞ্চয় খুব উপকারে আসে। তাই ভবিষ্যতে অর্থের সংকট মেটাতে সবার সঞ্চয় করার অভ্যাস করা জরুরি। কালকের কথা চিন্তা না করে আজ থেকেই অল্প অল্প সঞ্চয় করা উচিত। হতে পারে সেটা মাটির ব্যাংক, সমিতি, বেসরকারি সংস্থা বা কোনো তফসিলি ব্যাংক। শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের কাণ্ডারি, জাতির কারিগর, স্বপ্নের সিঁড়ি এবং শিক্ষার বিপরীতে তাদের সঞ্চয় ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের উত্তম বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং একই সঙ্গে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দেখাতে হবে এবং তাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সহায়তা করতে হবে।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com