স্কুল ব্যাংকিং: ভবিষ্যতের উত্তম বিনিয়োগ

মো. জিল্লুর রহমান: অর্থই অনর্থের মূল এবং এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থী অর্থের কারণে বখাটে হয়ে যায়। আর সময়মতো সঞ্চয় না করলে ভবিষ্যৎ অনেক সময় তাদের কাছে অন্ধকার মনে হয়। অর্থের অভাবে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া যায় না, কখনও লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। যেহেতু সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে স্কুল ব্যাংকিং খোলার সুযোগ আছে, তাই শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়া যাবে, কেননা শিক্ষার্থীদের আজকের সঞ্চয় ভবিষ্যতের উত্তম বিনিয়োগ ও আগামী দিনের সোনালি সোপানের ভিত্তি। ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু গড়ে তোলে সিন্ধু’এ কথাটা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে চরম সত্য।

কোমলমতি স্কুল-কলেজপড়–য়া ছেলেমেয়েদের জন্য যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা তা-ই মূলত স্কুল ব্যাংকিং। এ হিসাব থেকে কোনো চার্জ কর্তন করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে স্কুল ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে। স্কুল ব্যাংকিংয়ে টার্গেট গ্রুপ ১১ থেকে ১৭ বছরের তরুণ-তরুণী ও ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো আয়ের উৎস নেই। তারা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে উপহার বা নগদ অর্থ পেয়ে থাকে, অথবা নিয়মিতভাবে দুপুরের টিফিন বাবদ যে অর্থ পেয়ে থাকে, তা থেকে কিছু অর্থ বাঁচিয়ে জমা রাখার নিমিত্তে স্কুলের নিকটস্থ ব্যাংক শাখায় একটি সেভিংস হিসাব খোলার উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করাই স্কুল ব্যাংকিংয়ের উদ্দেশ্য।

আসলে স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও সঞ্চয় করার মনোভাব ও অভ্যাস গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। স্কুল ব্যাংকিং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। কমনওয়লেথ স্কুল ব্যাংকিং, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে স্কুল ব্যাংকিং একটি জনপ্রিয় সঞ্চয় বৃদ্ধির উদ্যোগ হিসাবে বিবেচিত। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের খরচ কমানোর মাধ্যমে সঞ্চয় করার অভ্যাস গড়ে তোলার নিমিত্তে এ ধরনের ব্যাংকিংয়ের শুরু হয়েছে।

স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা ছেলেবেলা থেকেই ব্যাংক হিসাব খোলার নিয়মকানুন ও হিসাব পরিচালনায় দক্ষতা ও অভ্যাস গড়ে তুলতে পারদর্শী হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকে জমা রেখে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তুলবে এবং নিয়মিত ব্যাংকে আসা-যাওয়া এবং টাকা জমা ও উত্তোলন করতে করতে একসময় দেখা যাবে সংশ্লিষ্টদের হিসাবে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে, যা টিফিনের পয়সায় বা গুরুজনদের দেওয়া উপহারের বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। আর এর মাধ্যমে সঞ্চয়ের যে অভ্যাস গড়ে উঠবে, তা সারা জীবন সুফল দেবে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের সেবা পৌঁছে গেছে দেশের প্রায় সবখানেই।

বর্তমানে আমাদের দেশে ৫৫টি ব্যাংকে বিদ্যমান এই স্টুডেন্ট ব্যাংকিং স্কিম। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে আছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ব্যাংক হিসাব চালাতে গ্রাহককে কোনো না কোনো চার্জ দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে স্কুলের শিক্ষার্থীদের এই হিসাব চালাতে কোনো খরচ দিতে হয় না, চেকবই নিতে গুনতে হয় না কোনো মাশুল। জমাবই, ডেবিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য সুবিধা তো আছেই। লেনদেন করা যায় যত খুশি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জন্য স্কুল ব্যাংকিংয়ের আমানত মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী আমানত, যা স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগযোগ্য।

সম্প্রতি ২০২০ সালের মার্চ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্কুল ব্যাংকিং শুরু হওয়ার ৯ বছরের ব্যবধানে অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ২৩ লাখ ছাড়িয়েছে। একই সময়ে সঞ্চয় স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭২৫ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও এখন ব্যাংকমুখী হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা তৈরি করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো ব্যাংক খাতে।

কোমলমতি স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং সুবিধা ও তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবার সঙ্গে পরিচিতি করানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের ২ নভেম্বর স্কুল ব্যাংকিং বিষয়ে একটি পরিপত্র জারি করে। এর পর থেকেই স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় মুনাফার নানা স্কিম চালু করে। ২০১০ সালে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বছরে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয় ২৯ হাজার ৮০টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় দেশের ব্যাংকগুলোয় মোট এক লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি হিসাব খোলা হয়। ওই সময় হিসাবগুলোয় মোট স্থিতি ছিল ৯৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর ২০২০ সালের মার্চ শেষে ২৩ লাখ ২৯ হাজার ১৩১টি হিসাবের বিপরীতে জমাকৃত সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তিন লাখ ৭৪ হাজার ৯০০টি। অর্থাৎ এক বছরে হিসাব সংখ্যার প্রবৃদ্ধি ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। এই সময়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের জমানো আমানত বেড়েছে ৯৯ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী স্কুল শিক্ষার্থীদের হিসাব সংখ্যা ও টাকা জমার স্থিতির দিক থেকে বেসরকারি ব্যাংকের অবদান সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি ব্যাংকগুলো মোট ১৬ লাখ ১২ হাজার ১১৩টি ব্যাংক হিসাব খুলেছে, যা মোট স্কুল ব্যাংকিং হিসাবের ৬৯ দশমিক ২২ শতাংশ।

স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ। ফলে ব্যাংকগুলোতে এই কার্যক্রমের আওতায় খোলা হিসাবের পাশাপাশি আমানতের পরিমাণও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এখন পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এক হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে, যা স্কুল ব্যাংকিং হিসাবের মোট স্থিতির ৮৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খুললেও মোট স্থিতির মাত্র ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, স্কুল ব্যাংকিংয়ের মোট হিসাবের ৩৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ খোলা হয়েছে গ্রামাঞ্চলে এবং ৬১ দশমিক ৪৩ শতাংশ খোলা হয়েছে শহরাঞ্চলে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান ২০১০ সালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চয় উদ্বুদ্ধ করতে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেন। তবে শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। ২০১১ সালে ১০ টাকা দিয়ে হিসাব খোলা হলেও পরে হিসাব খুলতে ১০০ টাকা জমা রাখতে বলা হয়। এসব হিসাব সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে রূপান্তরের সুযোগও আছে।

‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল’Ñসঞ্চয়ের ক্ষেত্রে এ কথাটি চরম সত্য। সঞ্চয় হচ্ছে ভবিষ্যতের মাপকাঠি, স্বপ্নের সিঁড়ি ও চরম বিপদের বন্ধু। ভবিষ্যতে বৃদ্ধ বয়সে অবসরকালে আরাম-আয়েশ করা, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, বিয়েশাদি, হঠাৎ অসুস্থ হলে চিকিৎসা ব্যয় মিটানো প্রভৃতি নানা প্রয়োজনে সঞ্চয় খুব উপকারে আসে। তাই ভবিষ্যতে অর্থের সংকট মেটাতে সবার সঞ্চয় করার অভ্যাস করা জরুরি। কালকের কথা চিন্তা না করে আজ থেকেই অল্প অল্প সঞ্চয় করা উচিত। হতে পারে সেটা মাটির ব্যাংক, সমিতি, বেসরকারি সংস্থা বা কোনো তফসিলি ব্যাংক। শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের কাণ্ডারি, জাতির কারিগর, স্বপ্নের সিঁড়ি এবং শিক্ষার বিপরীতে তাদের সঞ্চয় ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের উত্তম বিনিয়োগ।

ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক

rbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০