মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশের (আইসিএসবি) নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০ বছর ধরে নিরলসভাবে চার্টার্ড সেক্রেটারি বা কোম্পানি সচিব পেশার উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কোম্পানি সেক্রেটারিয়েল প্র্যাকটিস, করপোরেট গভর্নেন্স ও হিউম্যান রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পাঠদান করছেন। তিনি সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডে করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর ও কোম্পানি সচিব হিসেবে ৩১ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন শেয়ার বিজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসানুজ্জামান পিয়াস
শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ার গড়ার গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: ১৯৮৬ সালে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডে অ্যাকাউন্টস এক্সিকিউটিভ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। ১৯৮৯ সালে ওই প্রতিষ্ঠানে ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি হয়। এরপর করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগে কাজ শুরু করি। ১৯৯১ সালে করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ম্যানেজারের দায়িত্ব নিই। ১৯৯৭ সাল থেকে কোম্পানি সচিবের দায়িত্ব পালন করছি এবং ২০০৮ সালে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। তাছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদেও ছিলাম।
শেয়ার বিজ: ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গল্পটি জানতে চাই।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: এ প্রতিষ্ঠানের পথচলা শুরু ১৯৯৭ সালে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল ‘ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অ্যান্ড ম্যানেজারস অব বাংলাদেশ (আইসিএসএমবি)’। আমরা ১৩ জন মিলে আইসিএসএমবি প্রতিষ্ঠা করি। প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোজাফফর আহমেদ, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাইদুজ্জামান, ভাইস প্রেসিডেন্ট একেএ মুক্তাদির, ট্রেজারার ছিলাম আমি এবং সচিব ছিলেন এমএস আলম মিঞা এফসিএস। প্রথম ১৯৯৮ সালে চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইনটির খসড়া করা হয়। এ.কে.এ মুক্তাদির, শামসুল আলম মিয়া ও আমি খসড়াটি করেছিলাম। কিছু বিরোধিতা সত্ত্বেও সাবেক বাণিজ্য সচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশে চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইনটি বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-০৮) ক্যাবিনেটে আলোচনার পর এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। বাকি ছিল রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর। তবে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তখন অধ্যাদেশ হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এরপর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এটাকে এজেন্ডা হিসেবে নেন। তিনি আইনটি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি লুৎফুল হাই সাচ্চু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রাক্তন মন্ত্রী মওদুদ আহমদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বাণিজ্য সচিব ফিরোজ আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও হোসেন জিল্লুর রহমান সবাই আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন। অবশেষে ২০১০ সালে চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অ্যাক্ট-২০১০ নামে আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয়। প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ’ রাখা হয়। তাছাড়া আমার প্রথম দায়িত্বকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি একটি আকৃতিতে বা প্রবাহলাইনে আনার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব করা হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রথম ওয়েবসাইট তৈরি, কন্টিনিউয়িং প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (সিপিডি) প্রোগ্রাম শুরু করা, সদস্যদের উন্নয়নে প্রোগ্রামটি যেন নিয়মিত হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া, সিলেবাসের আপডেট, আন্তর্জাতিক মানে অন্তর্ভুক্ত করাসহ বেশ কিছু কাজ করা হয়। সদস্যদের জন্য তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রথমত, তাদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠনের সুপারিশ করা হয়। দ্বিতীয়ত, অবসরের সময়সীমা বাড়ানো ও ৬৫ বছর পর্যন্ত সক্রিয় সদস্য থাকলে তার আজীবন সদস্যপদের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সবশেষে এক্সিকিউটিভ ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে সবার ভূমিকা রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। কেননা প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সাল পর্যন্ত বাইরে থেকে কোনো অর্থ সহায়তা নেয়নি। এটি চলেছে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অবদানে। মেম্বার সাবস্ক্রিপশন ও ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্টের ওপর নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা তহবিল সংগ্রহ করি। তখন দুটি সেক্রেটারিয়েল স্ট্যান্ডার্ড ডেভেলপ করা হয়। আমরা আন্তর্জাতিক করপোরেট সেক্রেটারিয়েল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের (সিএসআইএ) স্থায়ী সদস্য হই।
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অ্যান্ড ম্যানেজারস অব বাংলাদেশের প্রথম ট্রেজারার হিসেবে আমিই কাজ করি। ১৯৯৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের পাঠ্যক্রম, পরীক্ষা পদ্ধতিসহ সব ক্ষেত্রে জড়িত ছিলাম। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি থাকাকালে প্রথম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে নেতৃত্ব দিয়েছি। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আমার হাতে তৈরি। তিন বছর বিরতির পর গত বছর থেকে আবারও প্রতিষ্ঠানটিতে সভাপতির দায়িত্ব পাই।
শেয়ার বিজ: আইসিএসবি গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য কী?
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: আগে থেকেই দেশে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) দুটি প্রতিষ্ঠান ছিল। কোম্পানি আইন-১৯৯৪ বা সদৃশ কোম্পানি আইনগুলো লক্ষ করলে দেখবেন, কোম্পানি সচিব পেশার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দেওয়া আছে। যেমনÑকমপ্লায়েন্স অফিসার, স্ট্যাটিউটরি অফিসার, পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা প্রভৃতি। অথচ কোম্পানি সচিব একটি সাংবিধানিক অবস্থান। প্রতিটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিব থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোম্পানি সচিবের প্রয়োজনীয় কিংবা আবশ্যিক যোগ্যতা কী হবে, সেটি অনেক দেশের আইনে উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশের কোম্পানি আইনে সঠিকভাবে বর্ণনা করা নেই। কোম্পানি আইনের ২নং ধারায় কোম্পানি সচিব বলতে মিনিস্টারিয়াল ও অ্যাডমিনিস্টারিয়াল ফাংশনে কর্তব্যরত কর্মীকে বোঝায়। সেখানে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কারণ প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হলো চার্টার্ড সেক্রেটারি। যেহেতু আমাদের দেশে ১৯৯৪ সালে এ-বিষয়ের কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, তাই উল্লেখ করা হয়নি। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিব বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন। এ অবস্থায় দেশে পেশাগত প্রতিষ্ঠান না থাকলে কীভাবে আমরা প্রফেশনাল কোয়ালিফিকেশন অফার করবো?
ব্যাপারটি উপলব্ধি করে ১৯৯৭ সালে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অ্যান্ড ম্যানেজারস অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করি। পরে নামটি পরিবর্তন করা হয়। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হচ্ছে, চার্টার্ড সেক্রেটারি পেশার উন্নতি বা বিকশিত করা।
শেয়ার বিজ: দেশে–বিদেশে চার্টার্ড সেক্রেটারির সম্ভাবনা কেমন?
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: এ পেশায় অনেক ধরনের কাজের সুযোগ রয়েছে। কোম্পানি সেক্রেটারি কাজের বাইরেও অনেক কাজ করতে পারেন। তিনি একজন ভালো প্রশাসক হতে পারেন। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকও হতে পারেন। তিনি ইন্টারনাল অডিট ম্যানেজার হতে পারেন। হতে পারেন সিইও কিংবা চেয়ারম্যান অথবা ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর।
একইভাবে দেশের বাইরেও অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে সরাসরি আপনি অন্য দেশের চার্টার্ড সেক্রেটারি সদস্যপদ নিতে পারবেন না। কারণ দেশভেদে কোম্পানি আইন ও সিকিউরিটিজ আইন ভিন্ন। ধরুন যুক্তরাজ্যের একজন চার্টার্ড সেক্রেটারিকে আমরা সরাসরি সদস্য করতে পারি না। কারণ তিনি এদেশের আইন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত নন। তবে তাকে কিছু বিষয়ে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি কিছু বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাকে সদস্য করা যেতে পারে। একইভাবে এ প্রতিষ্ঠানের মেম্বাররাও অন্য দেশে সদস্য হতে পারবেন।
শেয়ার বিজ: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চার্টার্ড সেক্রেটারি পেশায় ভূমিকা রাখার সুযোগ কেমন?
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: দেশের অর্থনীতিতে চার্টার্ড সেক্রেটারিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কোম্পানি সচিব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কার্যনির্বাহী। কোম্পানি সচিবের ভূমিকা, কর্মপরিধি ও দায়িত্ব করপোরেট সেক্টরের আধুনিক ধারা বিস্তারের ফলে বর্তমানে অনেক বেশি বিস্তৃত। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সুশাসন ও তৎসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধারার সংযোজনের ফলে কোম্পানি সচিবরা বর্তমানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের লক্ষ্যে কোম্পানি সচিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। করপোরেট খাতে উত্তম চর্চার নির্দেশনায় কোম্পানি সচিবকে পরিচালনা পর্ষদের সুষ্ঠু দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যিনি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আপনারা জানেন, কোম্পানি আইন, সিকিউরিটিজ আইন, করপোরেট গভর্নেন্স বিষয়ে কোম্পানি সচিব ওয়াকিবহাল। তিনি সরাসরি পরিচালনা পর্ষদকে পরামর্শ দিতে পারেন। পরিচালনা পর্ষদও তার ওপর নির্ভর করতে পারে। তিনি প্রতিষ্ঠানে একজন কমপ্লায়েন্স ও স্ট্যাটিউটরি অফিসারও বটে। করপোরেট ম্যানেজমেন্টে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে। শেয়ারহোল্ডার, পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার ঊর্ধ্বে থাকেন শেয়ারহোল্ডাররা। মূলত প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন কোম্পানি সচিব। এছাড়া দক্ষ ও কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠান চালাতে দায়বদ্ধ থাকে পরিচালনা পর্ষদ।
পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয় এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, নন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টরের সমন্বয়ে। এখানে নন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর সব সময় ডিরেক্টর হিসেবে কর্মে থাকেন না। তারা প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের কার্যক্রমও দেখাশোনা করেন না। কোম্পানি সচিব সব বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে পরিচালনা পর্ষদকে রিপোর্ট করেন। সুতরাং পেশাগতভাবে কোম্পানি সচিব যোগ্যতাসম্পন্ন না হলে পরিচালকদের কাজ কঠিন হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পরিচালকরা সব বিষয়ে আপডেট থাকেন না। অথচ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিরাপত্তা বজায় রাখাসহ নিয়ম-কানুন মেনে চলতে যোগ্য কর্মীর সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। ঠিক এখানেই কোম্পানি সচিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এমনকি অনেক সময় পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত কোম্পানি সচিবের উদ্দেশ্য পূর্ণ না করলে, সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা ঠিক নয়; কারণ সেটি কমপ্লায়েন্সের বিরুদ্ধে যাবে। প্রতিষ্ঠানের নাম, সুখ্যাতি খর্ব হবে। এ কারণে কোম্পানি সচিবকে ‘করপোরেট ম্যানেজমেন্ট রিপোর্টার’ বলা হয়। শুধু তা-ই নয়, কমপ্লায়েন্স অফিসার হিসেবে সরকারের কাছেও দায়বদ্ধ থাকেন কোম্পানি সচিব। কারণ তিনি সংবিধিবদ্ধ অফিসার। এসব কারণে বলতে পারি জাতীয় অর্থনীতিতে খুবই সহায়ক ভূমিকা রাখেন চার্টার্ড সেক্রেটারি।
শেয়ার বিজ: আইসিএসবি’র অগ্রগতি নিয়ে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: রোম একদিনে নির্মিত হয়নি। আমরাও রাতারাতি সফলতার মুখ দেখিনি। তবে আমরা অনেক পরিশ্রম করেছি। শুরু থেকেই চার্টার্ড সেক্রেটারি পেশার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। অথচ প্রয়োজনের তুলনায় চার্টার্ড সেক্রেটারির সংখ্যা কম। আমার জানামতে, প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কোম্পানি সচিবের চার্টার্ড সেক্রেটারি কোয়ালিফিকেশন নেই। বেশিরভাগই পুরোনো, প্রমোটিং অফিসার এ পদে আছেন। আমার ধারণা, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। চার্টার্ড সেক্রেটারিরা এ স্থান পূরণ করবেন। জেনে খুশি হবেন, গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার, ট্রান্সকম, সিঙ্গার, বার্জারসহ বেশ কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সচিব আমাদের প্রতিষ্ঠানের সদস্য। তারাই আইসিএসবি’র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। এখানেই আমরা সফল।
শেয়ার বিজ: আইসিএসবি নিয়ে আপনার স্বপ্ন…
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: বাংলাদেশে একটি নেতৃস্থানীয় পেশাদার প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই। প্রতিষ্ঠানটি হবে বিশ্বমানের। আমরা এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য সময়ের প্রয়োজন। গুণগত মান বজায় রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
শেয়ার বিজ: আইসিএসবি’র বর্তমান চ্যালেঞ্জ কী?
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণদের সংখ্যা কম। নতুন প্রজন্মের অনেকেই প্রতিশ্রুতিশীল নন। আমাদের বহু যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ আছে; কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আন্তরিক নন। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিক মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটিই বড় চ্যালেঞ্জ।
শেয়ার বিজ: এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহীদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ?
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। কারণ অ্যাকাউন্টিং ও ফাইন্যান্স পেশার জন্য রয়েছে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং ও এসিসিএ। আরও আছে সিএফএ। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য একজন ভালো প্রশাসক প্রয়োজন। চার্টার্ড সেক্রেটারি মূলত অ্যাডমিনিসট্রেটিভ পেশা। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে অনেক জোর দেওয়া হচ্ছে। করপোরেট আইন-কানুন ও তালিকাভুক্তির আইন-কানুনসহ ট্যাক্সেশন এবং এইচআর-অ্যাডমিন প্রভৃতি বিষয়েও তাদের দক্ষ হতে হবে। এ কারণে পেশাটি চ্যালেঞ্জের। পেশাটি এখনও বাংলাদেশে নতুন। এটি এখনও উঠতি পর্যায়ে। তাই আগ্রহীদের বলতে চাই এটি একটি আদর্শ পেশা।
শেয়ার বিজ: কোম্পানি সচিব পেশাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: কোম্পানি সচিব অত্যন্ত সম্মানজনক অবস্থান। সম্মানজনক পেশা। আগেই বলেছি, তিনি পরিচালনা পর্ষদের মুখপাত্র। দেখুন, ফাইন্যান্স ম্যানেজার প্রধানত সিএফও’র কাছে রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। মার্কেটিংয়ের প্রধান কর্তা এমডি বা সিইও’র কাছে জবাবদিহি করেন। কিন্তু কোম্পানি সচিব শুধু সিইও’র কাছেই নয়, তিনি পরিচালনা পর্ষদের কাছেও জবাবদিহি করে থাকেন। এর মধ্য দিয়ে করপোরেট নেতাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়। অতএব, কোম্পানি সচিবের অবস্থান বেশ শক্ত। তাছাড়া কোম্পানি সচিব শুধু শেয়ার ডিপার্টমেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন। এ কারণে তাকে দক্ষ হতে হবে। তাকে ফাইন্যান্স, ইনভেস্টমেন্ট, ট্যাক্সেশন, করপোরেট ল, সিকিউরিটিজ ল, সর্বোপরি করপোরেট গভর্নেন্সের ওপর সম্যক জ্ঞান ও প্রয়োগ জানতে হবে।
শেয়ার বিজ: কর্মক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোম্পানি সচিবের করণীয় সম্পর্কে বলুন।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্: আধুনিক ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা। কোম্পানি সচিব হতে হলে তাকে করপোরেট ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ আমার নিজের কথা যদি বলি, মূলত আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং গ্র্যাজুয়েট; কিন্তু ক্যারিয়ার হিসেবে আমি কোম্পানি সচিব পেশাকে বেছে নিয়েছি এবং ফাইন্যান্স, ট্যাক্সেশন, চার্টার্ড সেক্রেটারি, মার্কেটিং ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর কোর্স করেছি, জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেছি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কোম্পানি সচিব হওয়া সত্ত্বেও অ্যাকাউন্টিং, মার্কেটিং ও এইচআরের ওপর স্নাতকোত্তর বা কোর্স কেন? ওটা ছিল আমার ভিশন। নেতৃত্ব দিতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। যে কারণে কোম্পানি সচিবের কেবল বোর্ড ও শেয়ার ডিপার্টমেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। যে প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করবেন, সে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। বিশ্ব সম্পর্কে জানতে হবে। প্রতিনিয়ত বিশ্বে পরিবর্তন হচ্ছে। এমনকি পেশাগত কলাকৌশলেও পরিবর্তন আসছে। কোম্পানি সচিবকে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। আপনি আপডেট না থাকলে যোগাযোগ প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে ডিরেক্টর, শেয়ারহোল্ডার ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে। সবশেষে বলতে চাই কোম্পানি সচিবকে সৎ, আন্তরিক ও কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে।
Add Comment