মস্তিষ্কের ভেতরের কোনো অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত কিংবা বন্ধ হলে অথবা রক্তপাত হলে মস্তিষ্কের কলাগুলো প্রয়োজন অনুসারে অক্সিজেন বা শর্করার সরবরাহ পায় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই অবস্থাকে বলা হয় স্ট্রোক। মস্তিষ্কের কোষগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় অক্সিজেন ও শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলে কিছুক্ষণের মধ্যে এই কোষগুলো মরতে শুরু করে। আবার মস্তিষ্কের ওই কোষগুলো শরীরের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ওই অংশ প্যারালাইজড বা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
স্ট্রোক সাধারণ দুই ধরনের হয়Ñইসচেমিক স্ট্রোক (রক্ত বাধাপ্রাপ্ত) ও হেমোরেজি স্ট্রোক (রক্তপাতজনিত)।
কেন হয়
সাধারণত মস্তিষ্কের রক্তের সরবরাহে সমস্যার কারণেই স্ট্রোক হয়। মস্তিষ্কে রক্তের সরবরাহ কম হলে সেটা (ইসচেমিক স্ট্রোক) আবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে সেটা (হেমোরেজিক স্ট্রোক)। স্ট্রোকের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো হচ্ছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ কিংবা আঞ্চলিকভাবে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়াÑদুই অবস্থাতেই প্রায় একই ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায়।
লক্ষণ
মাথা ঝিমঝিম করা
প্রচণ্ড মাথাব্যথার সঙ্গে ঘাড়, মুখ ও দুই চোখের মাঝখান পর্যন্ত ব্যথা হওয়া
হাঁটা কিংবা চলাফেরা ও শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হওয়া
কথাবার্তা জড়িয়ে যাওয়া
শরীরের একপাশ দুর্বল, অসাড় কিংবা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া
চোখে অস্পষ্ট দেখা, অন্ধকার দেখা কিংবা ডাবল ডাবল দেখা
বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া প্রভৃতি
নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা
স্ট্রোক নির্ণয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ এসব ক্ষেত্রে রোগীর উন্নতির জন্য চিকিৎসকেরা হাতে খুব বেশি সময় (তিন থেকে ছয় ঘণ্টা) পান না। স্ট্রোক হয়েছে কি না সেটা বোঝার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন শারীরিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এর মধ্যে রয়েছে ব্লাড প্রেসার মাপা, রক্তে কোলস্টেরল পরিমাপ, ডায়াবেটিসের অবস্থা প্রভৃতি।
কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি স্ক্যান
এমআরআই বা ম্যাগনেটিক রিজোন্যান্স ইমেজিং
ইকোকার্ডিওগ্রাফির সাহায্যে জমাট রক্ত নির্ধারণ করা যায়
গারোটি আল্ট্রাসাউন্ডের সাহায্যে ঘাড়ের আর্টারির ছবি নিয়ে কোথাও রক্তনালি সরু অথবা বন্ধ হয়ে গেছে কি না, তা নির্ণয় করা যেতে পারে
কাদের হতে পারে
স্ট্রোক সাধারণত ৫৫ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষদের সবচেয়ে বেশি হয়। এছাড়া হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, অতিরিক্ত মোটা বা স্থূলতা প্রভৃতি রোগ থাকলে, ধূমপান বা অ্যালকোহলজনিত সমস্যা থাকলে, হৃৎপিণ্ডের অসুখ যেমন নাড়ির অস্বাভাবিক স্পন্দন, হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, হৃৎপিণ্ডের ত্রুটি কিংবা হৃৎপিণ্ডের সংক্রমণ প্রভৃতি রোগ থাকলে। কোনো হরমোন থেরাপি অথবাজন্ম নিয়ন্ত্রণ ওষুধ সেবনের ফলেও স্ট্রোক হতে পারে।
করণীয়
নিয়মিত ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা করা। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
সঠিক নিয়মে সময়মতো সঠিক পরিমাণে খাবার খেতে হবে।
নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রম অথবা সময় করে হাঁটা বা হালকা দৌড়াতে হবে।
শরীর যেন মুটিয়ে না যায়, অর্থাৎ দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
খাদ্যতালিকায় শাকসবজি, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি মাছ, দুধ, ভূসিসমৃদ্ধ খাবার প্রভৃতি রাখতে হবে।
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা যাবে না।
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
অ্যালকোহল বা নেশাজাতীয় কোনো দ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
চিকিৎসা
স্ট্রোকের চিকিৎসা প্রধানত রোগীর বয়স, মাত্রা, স্ট্রোকের ধরন প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে। স্ট্রোক হলে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। স্ট্রোক সাধারণত পুরোপুরি ভালো হয় না।
মেডিসিন
মেডিসিন ব্যবহারের ফলে পুরো ভালো হবে না। তবে স্ট্রোকের চিকিৎসা করে ভালো থাকা যাবে। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে একটি চিকিৎসা হচ্ছে থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি। এর মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ করে দ্রুত মস্তিষ্কের জমাটবাঁধা রক্ত গলিয়ে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করা হয়। কিন্তু মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ক্ষেত্রে এটা করা যায় না। স্ট্রোক হওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে এই থেরাপি দেওয়া হলে মস্তিষ্কের ক্ষতি অনেক কম হয়, প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
অপারেশন
অপারেশনের মাধ্যমে কিছু স্ট্রোক ভালো করা যায়। যেমন এনিরিজম থাকলে ক্লিপিং বা কয়েলিং করা যায়, ক্যারোটিড রক্তনালি বন্ধ থাকলে স্টেন্ট বা রিং পরানো যায়, অতিরিক্ত জমাট রক্ত বের করে দিলে রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়, কিছু বাইপাস সার্জারি করা যায়।
ফিজিওথেরাপি
রোগীর যতœ নিতে হবে সবসময়। ফিজিওথেরাপি করানোরও প্রয়োজন হতে পারে।
যা হতে পারে
স্ট্রোকের ফলে বেশকিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, মাংসপেশি অবশ হয়ে যাওয়া বা প্যারালাইসিস হওয়া, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, কথা বলতে সমস্যা হওয়া, কোনো কিছু বুঝতে সমস্যা হওয়া, খাবার খাওয়ায় অথবা খাবার গিলতে সমস্যা প্রভৃতি। নিউরোসার্জন বা নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে স্ট্রোকের রোগী এলে তিনি লক্ষণ দেখেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
গাউসুল আজম, চিকিৎসক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়