Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 2:13 am

স্ত্রীর গয়নার টাকায় কয়লার ফেরি

অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা।  পর্ব-৩৮

মিজানুর রহমান শেলী: পুঁজি সংগ্রহই হলো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রথম চ্যালেঞ্জ। অল্প পুঁজি নিয়েই তাদের শুরু করতে হয়। আস্তে আস্তে পুঁজি গঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকে যদি বিফলতাকে ছাপিয়ে ব্যবসায় সফলতার প্রাধান্য নিয়ম মেনে চলে। রেললাইনের মামলার ক্ষতিপূরণের টাকা আর স্ত্রীর গয়না বিক্রির টাকা নিয়ে তিনি লেগে পড়লেন। পরিবারসহ তখন তিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেছেন। যাহোক, ব্যবসায় তার ছোট পুঁজি। তাই মধ্যস্বত্বভোগী মাঝারি এন্টারপ্রাইজ বা ট্রেডার বলা যাবে না। কয়লার ফেরিওয়ালা বলাই যথেষ্ট হয়। কিছু কয়লা কিনে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করার মাধ্যমেই তিনি এই ব্যবসা শুরু করলেন। তবে বড় বড় সাপ্লাইয়ের পথ তিনি নিয়ত অনুসন্ধান করতেন। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এমনকি ব্রিটেন ঘুরে আসা এই বীরযোদ্ধার এক বুক সাহস নিজেকে সংকোচ আর বিহলতার মাঝে আটকে রাখার নয়। তিনি উচ্চাকাক্সক্ষা রাখতেন সব সময়।

যাহোক, বড় সাপ্লাইয়ের জন্য প্রয়োজন হয় পরিচিতি আর বড় পুঁজি। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সহযোগিতা তার দরকার ছিল। রণদা প্রসাদ সাহার সততা আর সাহসিকতা সবাইকে মুগ্ধ করত। তাছাড়া ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর ক্যারিয়ার তাকে ভারতজুড়ে বিশেষত কলকাতায় এক পরিচিত মুখে উদ্ভাসিত করেছে। তাই তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে যে কেউ আস্থা রাখতে পারেন, তাকে যে কেউই বিশ্বাস করতে পারেন।

সে সময় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার বিখ্যাত জমিদার রায়বাহাদুর সতীশ রায়চৌধুরী কলকাতায় থাকেন। নাগপুরে তার ব্যবসা। নাগপুরের ‘বঙ্গশ্রী কটন মিলে’র মালিক তিনি। রণদা প্রসাদ সাহাকে তিনি পছন্দ করতেন। রণদাকে সহযোগিতা করার আগ্রহ তার ছিল। রণদার এই সময় আর্থিক সহযোগিতা এবং বড় সাপ্লাইয়ের জন্য বড় কোনো মিল-কারখানার সঙ্গে চুক্তির প্রয়োজন। সৌভাগ্যবসত রণদা এ দুই সহযোগিতাই জমিদার সতীশ রায়চৌধুরীর কাছ থেকে পেয়ে গেলেন। তবে কয়লার ব্যবসায় রণদা শুরু থেকেই নিজের বুদ্ধিমত্তা আর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন সত্য। পাশাপাশি জমিদার সতীশ রায়চৌধুরী তাকে বুদ্ধি দিতেন। এমনকি রণদা সতীশ রায়চৌধুরীর পরামর্শ গ্রহণ করতেন সানন্দে। কার্যত, সতীশ রায়চৌধুরী অর্থ দিয়ে রণদাকে সহযোগিতা করেছিলেন; আর রণদাকে নিয়ত তার বঙ্গশ্রী কটন মিলে কয়লা সরবরাহের সুযোগ করে দিয়েছিলন। এই মিলটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের কোন্নগর শহরে। মহেষ বোস পাড়ায়। মূলত রিষড়ার মধ্যে অবস্থিত। রিষড়া দুটো শিল্পনগরীর সমন্বয়ে গঠিত। এর পূর্বদিকে রয়েছে হুগলি নদী। পশ্চিমে দিল্লি সড়ক। শ্রীরামপুর ও কোন্নগর শহরের মাঝে এর অবস্থান।

যাহোক, এটা যে রণদা প্রসাদ সাহাকে সতীশ চৌধুরীর পক্ষ থেকে একেবারে সরল বদান্যতা, তাও বলা চলে না। কেননা, সতীশ রায়চৌধুরীর মিলেও নিয়ত বিশ্বস্ত একটি কয়লার সরবরাহ মাধ্যমের প্রয়োজন ছিল। সেদিক থেকে তিনি রণদার সততা, সাহসিকতা আর পরিশ্রমী মানসিকতায় আস্থা রেখেছিলেন। বলা চলে একটি উভমুখী সুবিধার একটি যৌথ উদ্যোগ। বদান্যতা হোক আর ব্যবসায়িক চুক্তি যাই হোক রণদা এটাকে একটি যথাযথ সুযোগ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন।

রণদা বঙ্গশ্রী কটন মিলে কয়লা দেওয়ার সময় অবশ্য বসে থাকেননি। আরও বিভিন্ন কল-কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে বঙ্গশ্রী কটন মিলের অবস্থানটাও ছিল সুবিধামতো। কেননা পুরো রিষড়া তখন আরও অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল। যার ফলে এখন এটা দুটি শিল্পনগরীর সমন্বিত রূপ। বঙ্গশ্রীতে বড় বড় চালান দেওয়ার খাতিরে আড়ত ও মিলে তার একটি বড় পরিচিতি তৈরি হয়। এই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি আরও অনেক মিলে কয়লা সরবরাহের সুযোগ পেয়ে গেলেন। বিশেষ করে তিনি কাপড়ের মিলে কয়লা সরবরাহ করতেন।

তখন ভারতজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দাকালে ব্যবসায়িক লাভ থেকেই তাকে সংসারের খরচ মেটাতে হতো। আবার পুঁজি বাড়ানোর চেষ্টা, এমনকি সতীশ রায়চৌধুরীর ঋণ পরিশোধের ভারও তাকে বইতে হয়েছে। অর্থাৎ তিনি যে তখন রাতারাতি অনেক বেশি অর্থের মালিক হয়ে গেলেন এমনটি নয়। তাছাড়া সংসারও তার বেশ বড় হয়ে গেছে। কলকাতায় তখন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ অতটা সহজ ছিল না। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম বেশ বেড়ে যায়। এ সময় রণদা কলকাতার কোথায় কোন বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন, তা জানা যায়নি। তবে শোভাবাজারেই তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন।

যাহোক, ব্যবসায়ে নিয়ত অগ্রগতিতে রণদা আর একা সবকিছু সামাল দিতে পারছিলেন না। তখন তার একজন সহযোগী দরকার ছিল। শোভাবাজারেই ভাড়া থাকতেন তার বড় ভাই মদন সাহা। কাজের চাপে তিনি কোথাও যাওয়ার সুযোগ পেতেন না। ভাইয়ের বাসায় তাই না গিয়ে তিনি চিঠি লিখেছিলেন, আমি একা পারছি না। তুমি চলে এসো। দুই ভাই একসঙ্গে কাজ করব। চিঠি পেয়ে বড় ভাই মদন সাহা ছুটে যায় রণদাকে সাহায্য করতে। দুই ভাই একসঙ্গেই কয়লা সরবরাহের বড় বড় চালানের কাজ চালাতে লাগলেন। বিভিন্ন কাপড়ের কলসহ বড় বড় কল-কারখানা ও জাহাজের সঙ্গে তার ব্যবসা চলতে থাকল। এভাবে মাত্র চার বছরেই রণদা কলকাতায় সুপরিচিত ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন।

ঝুঁকি গ্রহণ যে কোনো ব্যবসার একটি বড় বৈশিষ্ট। তবে কেবল ঝুঁকি নিলেই ব্যবসায় সফল হওয়া যায় না। নির্দিষ্ট ব্যবসার সাংগঠনিক সংকটসহ সামগ্রিক সংকট আর সম্ভাবনা বুঝতে হয়। সেই সঙ্গে সংকট কাটিয়ে ওঠার মতো যথাযথ কৌশল বের করা ব্যবসায় সফলতার অনিবার্য দাবি। রণদা এ কাজটি সুচারুভাবেই করতে পেরেছিলেন। রণদা প্রসাদ সাহা যে কোনো ব্যবসার সাংগঠনিক সমস্যা বুঝতেন এবং এর ভালো সমাধান বের করতে পারতেন। তাই ঝুঁকি গ্রহণ তার জন্য সহজ হতো। কয়লার ব্যবসায় তার এক খরিদ্দার ছিলেন জাহাজের মালিক। হঠাৎ সেই জাহাজের মালিক যোগাযোগ এবং মূল্য পরিশোধে অনিয়মিত ও অনিয়ম শুরু করলেন। এতে রণদা প্রসাদের সন্দেহ হয়। নিশ্চয় কোনো সংকট এখানে তৈরি হয়েছে। রণদা বিভিন্নভাবে মূল সংকটটি জানা এবং বোঝার চেষ্টা করলেন। অবশেষে তার কাছে পরিষ্কার হলো, ওই জাহাজের মালিক বিভিন্ন রকম সাংগঠনিক দুর্বলতায় জাহাজ চালাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আর এ কারণেই তিনি কয়লার মূল্য পরিশোধে কথা রাখতে পারছেন না। রণদা তখন বিষয়টির আরও খুঁটে খুঁটে বোঝার চেষ্টা করলেন। কয়লার যে মূল্য সে মূল্যও হয়তো জাহাজ মালিক দিতে পারবেন না। কেননা তার ব্যবসায় তখন নিদারুণ অচলাবস্থা চলছে। তাহলে তিনি যদি জাহাজটিই কিনে নেন তবে কয়লার মূল্য ফিরে পাওয়া সম্ভব। আবার একই সঙ্গে জাহাজ ব্যবসার নতুন দিগন্ত উম্মোচন করা যায়। অন্তত তিনি একটি জাহাজের মালিক হবেন। এসব চিন্তার জায়গা থেকে রণদা আরও বেশি খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন। যদি তিনি জাহাজটি কেনেন, তবে কি তিনি জাহাজ ব্যবসায় নামবেন? নাকি জাহাজটি অন্যের কাছে বিক্রি করে কেবল মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে কিছু টাকা লাভ করেই ক্ষান্তি দেবেন? এসব নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি সে সময়ের জাহাজের ব্যবসার খুঁটিনাটি অবলোকন করতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এটা কেবল জাহাজ মালিকের সাংগঠনিক সংকট। উপরন্তু জাহাজের ব্যবসা তখন ভালোই চলছে। তিনি সহজেই জাহাজ ব্যবসায় নামলে লাভবান হবেন বলে তার আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হলো। উপরন্তু তিনি শুনতে পেলেন, জাহাজের মালিক জাহাজটি বিক্রির জন্য খদ্দের খুঁজছেন। এ অবস্থায় রণদা জাহাজটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। প্রস্তাবে জাহাজ মালিক রাজি হলেন এবং রণদা জাহাজটি কিনলেন। তবে ঠিক কত টাকার বিনিময়ে জাহাজটি কেনাবেচা হয়েছিল, তা জানা যায়নি। এই জাহাজ দিয়েই রণদার নৌ-পরিবহন ব্যবসা শুরু হলো। সময়টা তখন ১৯৩৬।

 

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ

mshelleyjuÑgmail.com