স্থিতিশীলতা রক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে বিএসইসিকে!

আতাউর রহমান: সূচক ও লেনদেনের ভালো অবস্থানে ফিরেছে দেশের পুঁজিবাজার। গত আগস্ট মাসে বাজারে সূচক বৃদ্ধির পাশাপাশি লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে দেখা যায়। বাজারের এই ভালো সময় গত দুই বছর আগের ভালো অবস্থানে ফিরে যাবে বলে আশা করছেন অনেক বিনিয়োগকারী। বর্তমান কমিশন ২০২০ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর মাঝামাঝি সময় থেকে যে উত্থান শুরু হয়, তা চালু থাকে পরের বছরের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর নানা কারণে উত্থান-পতনের মাধ্যমে সে বছর সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো লেনদেন তিন হাজার কোটি টাকার কাছে যাওয়ার পাশাপাশি ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স সাত হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। এরপর আবার ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পতনের মাধ্যমে সূচক ও লেনদেন কমতে শুরু করে। এরপর গত দুই বছর ধরে সূচক ও লেনদেনের উত্থান-পতন অব্যাহত থাকে। কখনও টানা পতন বা আবার কখনও টানা উত্থান, কিন্তু উত্থান-পতনের কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না।

পুঁজিবাজারের এ উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতা না থাকার পেছনে সবচেয়ে যে বড় কারণটি ছিল তা হচ্ছে বাজারে বড় ধরনের কারসাজি এবং সেই কারসাজি আটকাতে বা এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে বাজারের উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতা না থাকার পেছনে বিএসইসির পক্ষপাতিত্ব এবং একটি কারসাজি চক্রকে ছাড় দেয়াও হয়েছে বলে জানান তারা। বিএসইসি আলোচিত কারসাজি চক্রকে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাও করেছে বলে জানা যায়। এতে গত কয়েকদিন ধরে বাজারে যে সূচক-লেনদেন বাড়ছে এবং এ উত্থানের ধারাবাহিকতা রয়েছে সেটা ধরে রাখতে বিএসইসির নিরপেক্ষ আচরণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে কোনো কারসাজিকারীকেই ছাড় যেন না দেয়া এবং কাউকেই যেন সহযোগিতা করা না হয় সে বিষয়ে দাবি তুলেছেন।

গত দুই বছরের বাজার চিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, বাজারে সবচেয়ে বেশি যে কারসাজি হয়েছে এতে বিএসইসির নিরপেক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। কারণ গত দুই বছরে বেশ কিছু শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেছেন সরকারি কর্মকর্তা ও বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরু। এর মধ্যে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, জেনেক্স, ফরচুন শুজ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, আইপিডিসি, সাফকো স্পিনিং, ওয়ান ব্যাংক, এডিএন টেলিকম ও হামিদ ফেব্রিকসসহ আরও কিছু শেয়ার রয়েছে।

প্রথমে বিমা খাতের শেয়ারের মাধ্যমে কারসাজি শুরু হলেও পরে অন্যান্য শেয়ার নিয়ে চলে। এ কারসাজির সময় যখন কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বাড়তে থাকে তখন কোম্পানিগুলোর কাছে কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয় না এবং কোনো নজরদারিতে রাখা হয় না। কিন্তু অন্য কোনো কোম্পানির শেয়ার দর বাড়তে থাকলে বা অন্য কেউ কারসাজি করে তখন সেগুলোকে নজরদারিতে নিয়ে আসা হয় এবং পরে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে বোঝা যায়, হিরুর কারসাজিতে বিএসইসি ছাড় দিচ্ছে, যেটা একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কখনোই উচিত নয়।  

বিএসইসির এ নিরপেক্ষতা নিয়ে বাজার ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। এর প্রেক্ষিতে বেশ কিছু দিন আগে বিএসইসি বিষয়টি আমলে নিয়ে কিছু উদ্যোগ নিলেও একে শুধু ’আইওয়াশ’ বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা মনে করেন বিএসইসি সব কিছু দেখছে এবং তাদের কাছে সব তথ্য রয়েছে। বিএসইসি সব জেনেও নীরব রয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানিতে হাজার কোটি টাকার কারসাজি হয়েছে। এতে লাখো বিনিয়োগকারী পুঁজি হারালেও লাভবান হয়েছে একটি কারসাজি চক্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোম্পানির সঙ্গে মিলেমিশে কারসাজি করেছে জুয়াড়ি সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরু। হিরুর পাশাপাশি জাকির, সাইফুল, মিজান ও মোস্তফাসহ কয়েকজন জুয়াড়ি বাজারে থাকলেও তাদের তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন হিরু। এদিকে হিরু এক ডজনের বেশি কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকলেও দুটি কোম্পানির বিষয়ে অভিযোগ দিয়ে তাকে দায়মুক্তির চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসইসি ও ডিএসই। বিনিয়োগকারীদের দাবি, বিএসইসি এক বছর আগে কঠোর ব্যবস্থা নিলে লাখো বিনিয়োগকারী পথে বসতেন না। পাশাপাশি বাজার তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারত। কিন্তু বিএসইসি সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে জুয়াড়িদের মাধ্যমে সূচক বাড়িয়ে বাহবা নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বিএসইসির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানি করেছে সংশ্লিষ্টরা।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে বাজারের সূচক ও লেনদেন যে হারে বাড়ছে, এর পেছনে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ছে বলে মনে করলে হবে না। এর পেছনে বিএসইসির সুযোগ দেয়া একটি কারসাজি চক্র রয়েছে। যাদের কারসাজির সুযোগ দিয়ে সুচক ও লেনদেন বাড়িয়ে বাজারকে ভালো দেখানো চলছে।

তারা বলেন, বাজারে যেসব শেয়ারের দর বাড়ে এর বড় একটি অংশ কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হয়। বাজারে কয়েকটি কারসাজি চক্র রয়েছে। যখন এ কারসাজি চলতে থাকে তখন বিএসইসির পছন্দের কারসাজিকারীদের দাম বাড়ানো কোম্পানিগুলোর মধ্যে থেকে দু-একটির বিষয়ে খোঁজ নেয়া হয়। এবং পরবর্তীতে কোনো নজরদারি বা ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অপরদিকে বাকি কারসাজিকারীদের ক্ষেতে নজরদারি ও ব্যবস্থা দুটোই নেয়া হয়। 

সেটা কেন? এমন প্রশ্ন তুলে তারা বলেন, বিএসইসির এমন আচরণ কখনোই কাম্য নয়। তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে নিরপেক্ষ এবং শক্ত অবস্থানে থাকবে। বাজার তার আপন গতিতে চলবে, এখানে কোনো কারসাজি চক্রকে সুযোগ দিয়ে ভালো রাখার কিছুৃ নেই। বরং বিএসইসিকে সব কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বাজারকে তার আপন গতিতে স্থিতিশীল রাখাতে কাজ করতে হবে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বিএসইরিস ক্ষমতা অনেক। তাদের ক্ষমতার ওপরে শুধু হাইকোর্ট ছাড়া কেউ নেই। এখন বিএসইসি যদি কোনা একটা কারসাজি চক্রের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং চোখ বন্ধ করে রাখে তাহলে তো আর কারও কিছু করার থাকে না। এতে বাজার দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হবে না। বিএসইসি মুখে বলবে তারা সবার ক্ষেত্রেই সমান এবং সবার জন্যই নিরপেক্ষ। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সেটা যদি পাওয়া না যায় তাহলে কিছু করার নেই।

অপরদিকে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিএসইসির নিরপেক্ষতার বিষয়ে সব সময়  শোনা যায়। আমরা শুনতে পাই যে বিএসইসি একটি কারসাজি দলকে ছাড় দিচ্ছে, যেটা বাজারের জন্য ভালো না। বাজার তার আপন গতিতে চলবে, উত্থান-পতন থাকবে। সেক্ষেত্রে বিএসইসির কারও সঙ্গে বিমাতাসূলভ আচরণের সুযোগ নেই। বরং বিএসইসিকে সব কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কঠিন ও শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০