স্পেন, ইউরোপীয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই স্পেনের সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ সাধিত হয় মুসলিম শাসনামলে। ৭১১ সালে জিব্রাল্টারে তারিক বিন জিয়াদের অবতরণের মধ্য দিয়ে যার সূচনা হয়েছিল। দীর্ঘ সাতশো আশি বছরে মুসলিম শাসনামলে আইবেরিয়ান উপকূল পরিণত হয় সমস্ত ইউরোপের সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে। উঠে আসেন ইবনে রুশদ্, আব্বাস ইবনে ফিরনাস এবং ইবনে তোফায়েলের মতো মুসলিম পণ্ডিতেরা। আর এই সময়কেই গণ্য করা হয় ইহুদি সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে বিবিসির প্রতিবেদন, স্পেনে মুসলিম যুগকে প্রায়ই জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগ বলা হয়। যেখানে গ্রন্থাগার, বিদ্যালয় ও হাম্মামখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, আর সেই সাথে বিকাশ লাভ করেছিলো সাহিত্য, কবিতা এবং স্থাপত্যকলা।
একদিকে যেমন স্পেন তথা ইউরোপের প্রথম সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয় মুসলিমদের হাত ধরে ঠিক তেমনি সেই মুসলিমরাই দীর্ঘদিন ধরে নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল স্পেনের মাটিতেই। এক পর্যায়ে স্পেন থেকে সমূলে উৎখাটিত হলো মুসলিমরা । কেমন আচরণ করা হয়েছিল মুসলিমদের সাথে, কেনইবা তারা স্পেন ছাড়তে বাধ্য হলো তাঁরা ? সেটা নিয়েই আজকে আমার সংক্ষিপ্ত লেখা।
১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। সেই বছরটি আরেকটি বিশেষ ঘটনার জন্য বিখ্যাত। গ্রানাডায় নাসিরি বংশের শেষ শাসক দ্বাদশ মুহম্মদের আত্মসমর্পণের বছর। এ বছর ইতি ঘটে স্পেনে মুসলিম শাসনের দীর্ঘ অধ্যায়ের।
ক্যাথলিক কর্তৃক মুসলিম নির্যাতনের লোমহর্ষক ও বিভীষিকাময় ইতিহাস থেকে জানা যায় , মুসলিম কিশোরীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য টেনে হিচরে নিয়ে যাওয়া হতো, তাদের চিতকারে সমস্ত এলাকা ভারি হয়ে উঠতো ।
৯০ বছরের বৃদ্ধা মুসলিম মহিলাকে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়েছিল এবং ১০ ডুকাড জরিমানাও করা হয়েছিল, তাঁর একটাই অপরাধ তাঁর কাছে একটি কুরআনের কপি ছিল । একবার আশ্রয়হীন বৃদ্ধ, শিশু, স্ত্রীলোকেরা একটি বড় মসজিদে আশ্রয় নিলো। আশ্রিত মানুষসহ মসজিদটিকে বারুদের সাহায্যে উড়িয়ে দেওয়া হলো।
এক ইতিহাসবিদের বর্ননায় তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা এমন ছিল যে , তা লিখতে কলম অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে। আমি নিজে একজন মুসলিম নারীর ক্ষত বিক্ষত লাশ সটান হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি, যার চারপাশে তার সন্তানদের ছয়টি মৃত দেহ পড়েছিল।
তার একটি জীবিত দুগ্ধপোষ্য শিশু মায়ের দুধের পরিবর্তে রক্তপান করছিল। লোভী সৈন্যরা নারীদের মৃতদেহ থেকে গহনাগুলো খুলে নিচ্ছিল “। শূকরের মাংস ভক্ষণ ও মদ্যপান না করার জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করা হতো। তারা দলে দলে স্লোগান দিয়ে মুসলমানদের সর্বস্ব লুট করে তাদেরকে জোর করে খৃস্টান বানাতো, মসজিদগুলোকে গীর্জায় রুপান্তরিত করে তার দরজায় যিশুখ্রীষ্ট ও মেরির ছবি টাঙ্গানো হতো।
মুসলিমদের একটি জাহাজে ভরে সেটা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বহু মুসলিমকে অন্যায় ভাবে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল, ফাঁসির মঞ্চে তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হতো সে খৃস্টান নাকি মুসলিম হয়ে মরতে চায় ? মুসলিম বললে তাকে স্বাভাবিক ফাঁসি না দিয়ে চতুর্দিক থেকে পাথর ছুড়ে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিয়ে হত্যা করা হতো।
এভাবেই দীর্ঘদিন জুলুম নির্যাতন করে স্পেনের মুসলিমদের সমূলে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তারিক বিন জিয়াদ, ৭১১ খৃষ্টাব্দে মাত্র ১২ হাজার মুসলিম সৈন্যের মাধ্যমে এই স্পেনকে দখল করে ইসলামের পতাকা উড্ডিন করেছিলেন। দীর্ঘ ৭৮০ বছর এই স্পেনকে মুসলমানরাই শাসন করেছিল। সেই স্পেনেই কি করে মুসলমান পরাজিত হল তা আমাদের জানা দরকার।
জানা যায়, শাসকরা নিজেদের মনগড়া মতবাদে দেশ চালাতো। প্রজাদের বঞ্চিত রেখে নিজেরা বিলাস বহুল জীবন যাপন করতো, নিজেদের বসবাসের জন্য প্রাসাদ অট্টালিকা নির্মাণ করেছিল, অট্টালিকার সৌন্দর্য বর্ধনে নারীদের মুর্তি স্থাপন করেছিল, নিজেদের সুবিধার্থে আইন প্রণয়ন করতো, প্রজাদের ক্ষেত্রে ছিল দমনমূলক আইন, অনেক শাসক মুসলিম হয়েও আলেম ওলামাদের ওপর জুলুম নির্যাতন চালিয়েছিল।
মোট কথা প্রাথমিক সময়ে স্পেনের শাসনে শাসকরা বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর খলিফাদের নীতি অনুসরণ করলেও পরবর্তীতে তারা তা ভুলে গিয়েছিল। পরিনামে মুসলিমরা স্পেন থেকে সমূলে বিতাড়িত হয়েছিল।
স্পেন যেমন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তেমনি থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মায়ানমারের আরাকান রাজ্যও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। আরাকানের রোহিঙ্গা ভাই বোনদের উপর নির্যাতনের চিত্রও আমরা দেখেছি। ভারতীয় উপমহাদেশ দীর্ঘদিন মুসলিম শাসনাধীন ছিল। দিল্লী ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী।
দিল্লিতে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ট ছিল আর হিন্দুরা ছিল সংখ্যালঘু। খিলাফতের শাসনামলে যেখানে অর্ধপৃথিবী মুসলিম শাসনাধীন ছিল সেখান থেকে আমরা দিনের পর দিন এভাবেই হারিয়ে ফেলছি আমাদের মুসলিম সোনালি ঐতিহ্য!
নির্যাতন নিপীড়নের স্টিম রোলার চলমান রয়েছে বিশ্ব মুসলমানদের উপর। হে আল্লাহ, আমরা মুক্তি পেতে চাই, আমরা ফিরে পেতে চাই হারানো সেই আল হামরা, সেই কর্ডোবা যেখানে রক্ষিত আছে এক খন্ড দীর্ঘশ্বাস। মুক্তি পেতে চাই বিশ্ব জালিমের পিষ্টতা থেকে। হে আল্লাহ! মোদের সোনালি সুদিন তুমি ফিরিয়ে দাও। আমীন!

মোঃ মতিউর রহমান
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, ঢাকা ।
matiurrahman.ru@gmail.com