Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 12:47 am

স্প্রেড নির্দেশনা মানেনি ১০ ব্যাংক : শীর্ষে ব্র্যাক ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড

মেহেদী হাসান: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সত্তে¡ও ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) কমায়নি দেশি-বিদেশি ১০টি ব্যাংক। গত আগস্ট শেষে পাঁচটি বিদেশি এবং  পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকের স্প্রেড পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি ছিল। সবচেয়ে বেশি স্প্রেড রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংকের। এরপরেই রয়েছে বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকের স্প্রেড পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপর অবস্থান করছে। গত আগস্ট শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের ক্ষেত্রে গড়ে ৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ হারে সুদ আদায় করেছে। আমানতের বিপরীতে দিয়েছে পাঁচ দশমিক ২৭ শতাংশ সুদ; স্প্রেড দাঁড়িয়েছে চার দশমিক ৫১ শতাংশীয় পয়েন্ট।

বিদেশি ব্যাংকগুলোর স্প্রেড এখনও পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপর রয়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে এক দশমিক ৭৪ শতাংশ সুদ দিয়েছে। অন্যদিকে ঋণের বিপরীতে আদায় করেছে সাত দশমিক ৮৯ শতাংশ সুদ। এ খাতের ব্যাংকগুলোর স্প্রেড সবচেয়ে বেশি, যা ছয় দশমিক ১৫ শতাংশীয় পয়েন্ট।

স্প্রেড পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরের ব্যাংকগুলো হলো বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, সিটি  ব্যাংক এনএ, উরি ব্যাংক ও দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেড। বেসরকারি ব্যাংকগুলো হলো দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের আমানতের বিপরীতে গড়ে এক দশমিক ২৬ শতাংশ সুদ দিয়েছে। আর ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটি ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ সুদ নিয়েছে। বিদেশি খাতের এ ব্যাংকটির স্প্রেড দাঁড়িয়েছে আট দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। এ ছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক আমানতের বিপরীতে সুদ দিয়েছে তিন দশমিক শূন্য আট শতাংশ। আর ঋণের বিপরীতে সুদহার ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকের স্প্রেড দাঁড়িয়েছে আট দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, স্প্রেড পাঁচ শতাংশের নিচে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার নির্দেশনা দিয়ে আসছে। কিন্তু তা মানছে না বেশ কয়েকটি ব্যাংক। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আমানতের সুদের হার বেশি রাখতে হবে। যদিও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নীতিমালার আলোকে ঋণ ও আমানতে সুদহার নির্ধারণ করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত আগস্ট শেষে ব্যাংকগুলো ঋণের ক্ষেত্রে গড়ে ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ সুদ আদায় করেছে। আমানতের বিপরীতে চার দশমিক ৯৩ শতাংশ সুদ  প্রদান করেছে; ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে চার দশমিক ৫৩ শতাংশীয় পয়েন্ট।

গত আগস্টে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণের ক্ষেত্রে গড়ে আট দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে সুদ আদায় করেছে। আর আমানতের বিপরীতে দিয়েছে চার দশমিক ৫১ শতাংশ সুদ। এক্ষেত্রে স্প্রেড দাঁড়িয়েছে চার দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। তবে বিশেষায়িত ব্যাংকের স্প্রেড সবচেয়ে কম; যা মাত্র দুই দশমিক সাত শতাংশ। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক আমানতের বিপরীতে গড়ে পাঁচ দশমিক ৯৫ শতাংশ সুদ দিয়েছে। আর ঋণের ক্ষেত্রে সুদ নিয়েছে আট দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে।

ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ব্যাংকের কাছে প্রচুর পরিমাণে অলস টাকা পড়ে আছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে না। আবার খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এত কিছুর পরও বছর শেষে রয়েছে ভালো মুনাফা অর্জন করার টার্গেট। ফলে আমানতকারীদের দিকে খেয়াল না রেখেই বছর শেষে ভালো মুনাফা অর্জনের স্বার্থে আমানতের সুদ কমাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বর্তমানে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় এর প্রভাব তেমন একটা পড়ছে না। তবে একটা সময় আমানতকারীরা তাদের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করবে। তখন আমানত কমে যাবে। ফলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারবে না; ব্যবসাও কমে যাবে। ব্যাংকগুলো এখন হয়তো আমানতের সুদ কমিয়ে লাভ করছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এটা সম্ভব হবে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েক বছরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ধীরে ধীরে কমছে আমানতের সুদহার। ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদের হার চার দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আর এর আগের বছর ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ছিল পাঁচ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদের হার ছিল ছয় দশমিক আট শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছর শেষে ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ছিল সাত দশমিক ৭৯ শতাংশ। গত কয়েক বছর ধরে আমানতের সুদের হার কমার পাশাপাশি ঋণের সুদহারও কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। তবে ব্যাংক আমানত এবং ঋণের সুদহারের ব্যবধান এখনও অনেক বেশি।

এদিকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকের আমানতের সুদহার কমার ফলে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন সাধারণ মানুষ। কেননা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে এখনও ১১ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির থেকেও নিচে নেমে গেছে; যা ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনি সংকেত। আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় ব্যাংকবিমুখ হবে মানুষ, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক।