নিজস্ব প্রতিবেদক: সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকা, সমন্বয়ের অভাব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক কারণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার সুবিধা যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে যাচ্ছে না। ফলে বরাদ্দ থাকলেও এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সুবিধা পাওয়ার যোগ্য মানুষ। এই দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে আরও ৪৫ শতাংশ ব্যক্তিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় আনা সম্ভব বলে দাবি করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফল পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় সিপিডি আয়োজিত ‘সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ঘাটতি নিরূপণ এবং বৃহৎ সামাজিক অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক সংলাপে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে মূল গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। সংস্থাটি সারাদেশের আট বিভাগের ১৫ জেলার ২৯ উপজেলার ৪৮৬ জনের ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করে। এতে উল্লেখ করা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের ভাতাপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বয়স্ক ও ৩৩ শতাংশ বিধবা অযোগ্য সুবিধাভোগী রয়েছেন। এসব ভাতা-সংক্রান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য জনপ্রতি গড়ে চার থেকে ছয় হাজার টাকা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দিতে হচ্ছে।
সিপিডি বলছে, গবেষণায় অংশগ্রহণ করা ৯৭ শতাংশ মানুষ সব ধরনের ভাতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৮৫০ টাকা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা, বয়স্ক ভাতা ৬০০ টাকা এবং বিধবা ভাতা ৫৫০ টাকা খুবই নগণ্য। আবার এসব ভাতা তিন মাস বা কখনও কখনও ছয় মাস পরপর পাওয়া যায়। ফলে এই টাকা দিয়ে তেমন কিছুই করা সম্ভব হয় না। সিপিডি মনে করছে, বর্তমান সুবিধাভোগীর প্রয়োজন বিবেচনায় টাকার পরিমাণ যদি বাড়ানো যায়, অর্থাৎ দুই
হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা করা হয়, তাহলে অতিরিক্ত তিন হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা প্রয়োজন। কর ফাঁকি ও কর অস্বচ্ছতার মাধ্যমে প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। সেটা যদি আদায় করা সম্ভব হয়, তাহলে সেখান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এ খাতে ব্যয় করা সম্ভব। তাদের হিসাবমতে, কর ফাঁকি ও কর পরিহারের মাধ্যমে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। কর ফাঁকি যদি ৮০ শতাংশ হয়, তাহলে দুই লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারায় সরকার। আবার যদি কর ফাঁকি ৫০ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে সরকার রাজস্ব হারায় ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
সংস্থাটির মতে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় থাকা ছয় শতাংশ মানুষ একাধিক জায়গা থেকে ভাতা পাচ্ছেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকা। পাশাপাশি বয়স্কভাতাপ্রাপ্তদের ৭৮ শতাংশ মানুষের নিজস্ব জমি নেই, ২২ শতাংশের নিজস্ব জমি আছে এবং সাত শতাংশের নিজস্ব বাড়ি আছে। সুবিধাভোগীদের ৪২ শতাংশ বরিশাল বিভাগের। তবে অঞ্চলভিত্তিক বয়স্কভাতাপ্রাপ্তদের বেশির ভাগ রাজশাহী বিভাগের। এর পরে রয়েছে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অবস্থান। বয়স্কভাতাপ্রাপ্তদের মাসিক গড় আয় ১০ হাজার টাকা। তাদের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যারা বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ততার ভাতা পান, তাদের ৮৮ শতাংশের নিজস্ব জমি নেই, ১৩ শতাংশের নিজস্ব জমি আছে। এ খাতের সব থেকে বেশি সুবিধাভোগী রংপুর বিভাগের, শতাংশের হারে তা ৩৩ শতাংশ। তাদের ১০-১২ শতাংশ কৃষি ও সেবা খাতের সঙ্গে যুক্ত।
উপবৃত্তি প্রাপ্তিতে সব থেকে এগিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগ, আর সব থেকে কম উপবৃত্তি পায় খুলনা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। জরিপে অংশ নেয়া ৮৫ শতাংশ পরিবারের একজন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করা ও যথাযথ কাগজপত্রের অভাবে পাঁচ থেকে ৩০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদেরও ওই সুবিধার আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করে সিপিডি।
সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, দারিদ্র্যসীমা ও বৈষম্যের ফারাক তুলনাহীন জায়গায় চলে গেছে। ফলে দিন দিন সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কোনো দান বা খয়রাত নয়, এটা অধিকার। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে শুরু হয়েছিল। এটাকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার পরিমাণ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে সরকারি পেনশনকে অন্তর্ভুক্ত করে বড় বরাদ্দ দেখানো হয়। আমরা এটাকে বাদ দেয়ার জন্য বললেও তা করা হয়নি। তবে এবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সেটা আবারও বলেছে। এতে সরকার হয়তো এবার শুনবে, কারণ আমরা বিদেশিদের কথা ভালো শুনি। আজকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধিতে সিপিডি যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা যৌক্তিক। সামাজিক ভাতা পাওয়ার ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তি শনাক্তকরণে দুর্নীতি রয়েছে। তবে মনিটরিং করার জন্য সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত লোকবল সংকট রয়েছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘নগরের অভাবগ্রস্তরা কারও নজরে আসে না। হরিজনদের ক্যাম্পে গেলে প্রকৃত চিত্র দেখতে পাবেন। নগরের অভাবগ্রস্তদের আমরা খেয়ালই করি না। ঢাকা শহরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা কী? এই জায়গায় গবেষণা প্রয়োজন। ২০১৫ সাল থেকে এখনও প্রাথমিক শিক্ষায় উপবৃত্তি ১৫০ টাকার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। বিষয়টি কি কারও নজরে আসে না?’