স্বপদে থাকতে সত্যকথন বড় প্রয়োজন

মোহাম্মদ আবু নোমান: পদে যখন ছিলেন বিবেককে কোমায় রেখে, ক্ষমতার লোভে অন্ধ ছিলেন! এখন ক্ষমতা নেই, পদও নেই, অথচ বিবেক জাগ্রত! নুনের মেয়াদ শেষ, গুণ গাওয়াও বাদ! দুধ-ননী, মাখন-ঘোল, কমিশন, সবটা খাওয়ার পর ৩৬০ ডিগ্রি পল্টি দিয়ে নগ্ন সত্য বলতে পারলেন। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, ভোটারবিহীন গণবিচ্ছিন্ন নির্বাচন, শতভাগ ভোট, নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট, নির্বাচন ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত, বিপন্ন ও মানুষ খুনের দায়ভার কার? এ দেশে দায়িত্ব থেকে সরে গেলে সবাই সুশীল হয়ে যান। আপনার জীবন কাহিনী ছিল রোমান্টিকে ভরপুর! যা করে গেলেন দেশ-তথা বিশ্ববাসীর কাছে চিরস্মরণীয় ও অম্লান হয়ে থাকবেন। নির্বাচন ব্যবস্থাকে চৌদ্দটা বাজিয়ে, শশ্মানে পাঠিয়ে, ১৭ কোটি মানুষের বিশ্বাসকে খুন করে, আজ কৌতুককর সদুপদেশ ডেলিভারি করে বলছেন, ‘রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং;’ আরও বলেছেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। বিএনপিকে বাদ দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা হলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।’ তাহলে অতীতে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আপনি যে একতরফা নির্বাচন করেছেন সেগুলো গ্রহণযোগ্য হয়েছে কী? লোকলজ্জা বা চক্ষুলজ্জা বলেও একটা কথা আছে। এছাড়া বিএনপিকে ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের হাজার হাজার নির্বাচন করলেন কেন? সাবেক সিইসি যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলতে হয়, আপনি দায়িত্বে থাকতে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য কিছু করলেন না কেন? কী কারণে রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করল, তা তলিয়ে দেখেছিলেন কি? দেখার মতো চোখ আপনাদের ছিল কি? যাই হোক আপনি দেশবাসীর নজর ও আগ্রহে আছেন, আরও অনেক চটকদার বাক্য ডেলিভারি শোনার অপেক্ষায়।

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। গত ৪ জুন ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্ভব’ জাতীয় বিতর্কের বিষয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে শিক্ষার্থীরা বলেছেন। এর উদ্দেশ্য নির্বাচন ও গণতন্ত্র সম্পর্কে নতুন প্রজšে§র সচেতনতা বাড়ানো। কিন্তু গত পাঁচ বছরের নির্বাচনী পরীক্ষায় প্রায় শতভাগ ‘ফেল’ করা সাবেক সিইসির কাছে দেশের সর্বসাধারণ, বিশেষত কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আর যা-ই হোক নির্বাচন নিয়ে ‘বেহুদা’ ইডিফিকেশন (শিক্ষাদীক্ষা) অ্যাডভাইসমূলক লেসন শুনতে চায় না।

সিইসি পদে থাকা অবস্থায় তিনি এই সাধু ও অতি আবশ্যকীয় সদুপদেশ মনে রাখলে নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ধ্বংস হতো না। তিনি এখন সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে তার পথ বাতলাচ্ছেন। ক্ষমতায় থাকতে তিনি আমেরিকানদেরও ‘সুষ্ঠু ভোট’ শিক্ষা দেয়ার কথা বলতেন।

গত ৪ জুন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির বিতর্ক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা স্বীকারও করেছেন, ‘বেশ কিছু কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়াটা ছিল অস্বস্তিকর।’ তাহলে বলতে হয়, এভাবে ভোটপড়া নির্বাচনগুলো আপনি বাতিল করেছেন কি না? জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি বা কমিশন কর্মচারীদের পক্ষপাত বা দায়িত্ব অবহেলার জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলার বিধানও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের হতে পারে জেল-জরিমানা। অথচ নির্বাচনে বড়বড় অকারেন্স ঘটলেও কমিশনকে কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি।

এছাড়া গত ১২ জুন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সাবেক সিইসি, ইসি ও ইসি সচিবগণ মতবিনিময়কালে বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে, তা গ্রহণযোগ্য হবে না।’ অথচ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ও নির্বাচন কমিশনের সচিবেরা একথা স্পষ্ট করে বলেননি, আমাদের নির্বাচন ব?্যবস্থা কেনো, কীভাবে ধ্বংস হলো? আমরা জানতে চাই আরও বড় পরিসরে সে আলোচনা কখন-কবে হবে? ইসি, সিইসি, সচিব মহোদয়গণ যতই মাথা চুলকাতে থাকুন না কেনো, কাজির কাজ যতদিন রাজনীতিবিদদের হাতে থাকবে, ততদিন প্রহসনের নির্বাচনের দাবানলের সমাপ্তি হবে না। সত্য হলো, সরকার বা নির্বাহী বিভাগ না চাইলে দেশে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব।

১২ জুন আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যেসব কথা বলেছেন, সেসব কথা কি কমিশনের সদস্য ও আমজনতার অজানা? এসব গুরুত্বপূর্ণ কথা আগেও নির্বাচন কমিশনের সংলাপে, মিডিয়া ইভেন্টে, মতবিনিময় সভায় কিংবা গণমাধ্যমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা চটকদার বক্তৃতায় বহুবার বলেছেন। বিগত হুদা কমিশন দায়িত্ব নিয়ে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপও করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তারা সেসব পরামর্শের ধারেকাছে যাননি। কাজ করেছেন ‘ওপরের নির্দেশ’ অনুযায়ী। বাংলাদেশের সবকিছু চলে ওপরের নির্দেশে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশ্বাস, সহাবস্থান, দেশাত্ম্যবোধ, সাধারণ মানুষের মঙ্গল কামনা কোনো দলের মধ্যেই নেই। সবারই লক্ষ্য ক্ষমতা। ক্ষমতা থাকলে আমাকে ঠেকাবে কে? যে কারণে ক্ষমতায় গিয়ে চলে প্রতিশোধের পালা। আমরা দেখেছি ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট, দশ ট্রাক অস্ত্র আমদানি, দুর্নীতির গোলাঘর নামক হাওয়া ভবন, লগি-বৈঠার তাণ্ডব, লাগাতার আন্দোলন, জঙ্গি সন্ত্রাসের উত্থান, আগুন সন্ত্রাস, পেট্রোল বোমার তাণ্ডবসহ আর কতও কী? সবকিছুর প্রয়োজনে চাই ক্ষমতা, আর ক্ষমতার উৎস নির্বাচন। সেই নির্বাচন হবে নানা ছলে-বলে, কৌশলে, সংবিধানের দোহাইয়ে দলকে জেতানোর কৌশলে। সোজা কথায় জিতলে ঠিক, না জিতলে বেঠিক।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই নানা অকারেন্স ও দুর্নীতির বৈতরণী পার পাওয়ার জন্যে নির্বাচন ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করেছে। কারণ নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে, শপথ ভুলে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অতীতের দুর্নীতি ও আগামীতে সর্বস্তরে লুটপাটে মেতে ওঠা যাবে। দেশের দেউলিয়া ও জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে আমাদের দেশে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন বরাবরই গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অথচ আমরা দেখেছি, ভারতের প্রয়াত সিইসি টি এন সেশন নির্বাচনের পরিবেশ অনুকূল না থাকলে একের পর এক নির্বাচন স্থগিত করে আবার তারিখ নির্ধারণ করেছেন কারও পরোয়া না করে।

গত পাঁচ বছরে নূরুল হুদা কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন করেছে। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এসব নির্বাচন ছিল সহিংস, সংঘাতময় ও জবরদস্তিমূলক। আবার কোনো কোনো নির্বাচন ছিল ভোটারবিমুখ। ওই অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীরা যে যেখানে পেরেছেন, জবরদস্তি করেছেন, চর দখলের মতো মহড়া দিয়েছেন।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি দেশে ও বিদেশে, এটা সর্বজনবিদিত। ১৯৯১ সালের নির্বাচন পরিচালনার সময় সিইসি ছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। সে নির্বাচন প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। আবার সে কমিশনই মাগুরা উপনির্বাচনে এর ছাপ রাখতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের অতি সফল আবু হেনা কমিশনকে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের সময় বিপন্ন মনে হয়েছিল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের স্মৃতি অম্লান। নবগঠিত কমিশনে যারা গেছেন, তাদের এ ইতিহাস অজানা নয়।

সম্প্রতি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয় ইসি। কিন্তু এই সংসদ সদস্য তা না মানায় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ইসির কিছুই করার নেই।’ কুমিল্লা সিটির নির্বাচন নিয়ে ইসির বক্তব্যে পূর্বাভাস লক্ষ্যণীয় যে, ভবিষ্যৎ কেমন হবে, এই কমিশনের সক্ষমতা কতটুকু। একজন সংসদ সদস্যের নির্বাচন কমিশনের কথা না মানায় যদি নির্বাচন কমিশন পিছু হটে, ভবিষ্যতে ৩০০ সংসদ সদস্যকে নিয়ে কী করবেন? গণমাধ্যমকর্মীদের এই প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘আইনি কাঠামো যেভাবে আছে, সেভাবে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। উনি (বাহাউদ্দিন) আইন মানেন না, আইনপ্রণেতা। আমাদের ব্যর্থ বলেন কেন আপনারা? একজন সম্মানিত লোককে টেনেহিঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়।’ আমরা বলতে চাই, দেশের আইন কানুন-মানেন না, এমন লোক সম্মানিত হয় কীভাবে? তাহলে জাতীয় নির্বাচনে যদি পুরো প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি দল, বিরোধী দলসহ অন্যরা নির্বাচন কমিশনের আদেশ অমান্য করার চেষ্টা করে, তাহলে নাগরিকেরা কোথায় যাবে!

কাজ শুরু হতে না হতেই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল কি হার মানলেন? আত্মসমর্পণ করলেন? একজন আ ক ম বাহারউদ্দিন বাহারের বাহাদুরিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো? এলাকা ছাড়তে এমপিকে জোর করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেইÑএমন বক্তব্য দেয়ার পরই এসব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তিনি সংসদ সদস্যকে জোর করে এলাকা থেকে বের করতে পারেন না ঠিক। কিন্তু তিনি তো ইচ্ছা করলে নির্বাচন স্থগিত করে দিতে পারেন। এ ক্ষমতা তো তার রয়েছে। তিনি সেটা করেননি।

অনিয়ম প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যদি ইসির করার কিছুই না থাকে তাহলে সাংবিধানিক এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে থাকার কী প্রয়োজন! তাহলে তো ভোটে কারচুপি হলে ইসি বলবে, আমরা কারচুপি করতে নিষেধ করেছি, তারা না শুনলে আমাদের করার কিছুই নেই! কেউ ভোটকেন্দ্র দখল করে নিলেও ইসির কিছুই করার নেই! এভাবে হলে সর্বসাধারণ ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কী ধারণা করবে? বর্তমানের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের গন্তব্য কি তবে পুরোনো পথেই?

সাংবাদিক

abunoman1972@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০