অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা। পর্ব-১৩
মিজানুর রহমান শেলী: সাহাপাড়া ছাড়বেন। কিন্তু কোথায় যাবেন রণদা। বাবার বাড়ি, মামার বাড়ি কোথাও তার জায়গা হলো না। রক্তের বন্ধনও তাই তার আর আপন বলে মনে হয় না। কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তিনি যাবেন না। কেবল মাথা গোঁজার ঠাঁই যদি তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতো তবে নিশ্চয় তিনি দেশেই কোথাও কোনো আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবের শরণাপন্ন হতেন। অথবা দেশের মাটিতেই কাজ খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা চালাতেন, অন্তত কিছুদিন। তা তিনি করেননি। বুদ্ধি আঁটলেন কলকাতা পৌঁছাবেন। কিন্তু এই ঘোর সন্ধ্যায় তিনি কীভাবে কলকাতার পথে পা বাড়াবেন! উপায়ান্তর না দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মামাবাড়ি আগে যাবেন। তবে সেখানে স্থায়ী হওয়ার ঘুণাক্ষরেও কোনো কারণ থাকতে পারে না। যা হোক, তিনি সাহাপাড়া ছেড়ে শিমুলিয়ার পানে হাঁটলেন। কিন্তু গোধূলি পার হয়ে সন্ধ্যার এই ক্ষণে শিমুলিয়া যাত্রাও সহজ ছিল না।
সে সময় টাঙ্গাইলের যাতায়াতব্যবস্থা ছিল নাজুক। রেলপথই ছিল সে সময়ে বাংলার সর্বাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা। কিন্তু টাঙ্গাইলের কোথাও তখনও রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়নি। টাঙ্গাইল তথা মির্জাপুরের যোগাযোগব্যবস্থার একই দশা। নৌ ও সড়কপথই ছিল মাধ্যম। তবে সড়কপথে দূরযাত্রা ছিল অসম্ভব। সম্ভ্রান্ত ঘরের লোকেরাই কেবল দেশি গাড়িতে চেপে সড়কযাত্রা করতেন। মোগল আমলে ঢাকা থেকে একটি রাস্তা উত্তর বিহারে পৌঁছেছিল। এ রাস্তাটি টাঙ্গাইল জেলার বক্ষ ভেদ করে এগিয়ে যায়। রেনেল তার রোডবুকে এ রাস্তাটিকে ঢাকা-মালদা রাস্তা বলে উল্লেখ করেছেন। রাস্তাটি সন্তোষের কাছে লৌহজং নদী, গন্ধকপুরের কাছে যমুনা নদী এবং পাবনার বেলকুচির কাছে কোনাই নদী অতিক্রম করেছিল। তবে রণদা প্রসাদের বাবার বাড়ি মির্জাপুর থেকে টাঙ্গাইল অবধি এ রাস্তার অস্তিত্ব ছিল নামমাত্র। ছিল অসংখ্য ভাঙন। কোনো পাকা সেতু ছিল না। এ রাস্তার একটি শাখা পাকুল্লা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে জামালপুর পৌঁছেছিল। তাছাড়া মধুপুর গড় হয়ে মুক্তাগাছা ও গাবতলী থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত একটি রাস্তা ছিল। তবে তা রণদার শৈশববেলার আগেই আঠারো শতকের শেষার্ধে অস্তিত্ব হারিয়েছিল।
ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত রাস্তাটি মুক্তাগাছা, মধুপুর ও কালিহাতী অতিক্রম করেছিল। এর দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ মাইল। এটাই ছিল রণদার শৈশবকালে টাঙ্গাইল জেলার একমাত্র ভালো রাস্তা। এ রাস্তার ওপরে বেশ কয়েকটিতে পাকা সেতু ও ফেরির ব্যবস্থা ছিল, যেমনÑগাবতলী, কালিহাতী, সোলাকরা ও পউলিতে। তবে টাঙ্গাইল থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত রাস্তাটি ছিল প্রায় পরিত্যক্ত। এর সেতুগুলো ছিল জঙ্গলাকাকীর্ণ ও জরা-জীর্ণ। আরেকটি রাস্তা তখন ভালো ছিল। এটা মধুপুর হয়ে গোপালপুরের ভেতর দিয়ে হেমনগরে পৌঁছেছিল। রাস্তাটি সারা বছর যোগাযোগের উপযোগী থাকত। আরেকটি রাস্তা গোপালপুরকে ঘাটাইল ও কালিহাতীর সঙ্গে যুক্ত করে। এর একটি স্থানে বড় ভাঙন ছিল। তাছাড়া আরও কিছু রাস্তা জামুরকী, পাকুল্লা থেকে করটিয়া, দেলদুয়ার হয়ে টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল থেকে বাসাইল, টাঙ্গাইল থেকে এলাশিন ও নাগপুর পৌঁছেছিল।
টাঙ্গাইল থেকে এলাশিন ও নাগপুরের রাস্তাটি ছিল বেশি গুরুত্ববাহী। কেননা এলাশিনের পাটের ব্যবসা তখন ছিল জমজমাট। খুব বেশি ভাঙন এ রাস্তায় ছিল না। তাই টাঙ্গাইল জেলায় পৌঁছবার জন্য এ রাস্তাটিকে সবাই পছন্দ করত। তাছাড়া লঞ্চ ও স্টিমারেও এলাশিনে যোগাযোগ ছিল। সরিষাবাড়ী থেকে একটি রাস্তা টাঙ্গাইল পৌঁছেছিল। শীতকালে এ রাস্তা ছিল বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু হেমনগর থেকে ভুয়াপুর পর্যন্ত এর অবস্থাটি ছিল নাজুক।
১৯ শতক থেকে ২০ শতকের ২০ দশক পর্যন্ত এখানকার যানবহন ছিল দুই রকম। একটি শহুরে। আরেকটি গ্রামীণ। শহরের একমাত্র যানবাহন ছিল ছ্যাকরা ঘোড়ার গাড়ি। গ্রামাঞ্চলে চলত গরুর গাড়ি। ভাড়ায় খাটত। গ্রামে এ গরুর গাড়ির প্রচলন এখনও আছে। তবে ১৯ শতকের মাঝ বরাবর টাঙ্গাইলের শহর অঞ্চলে ছ্যাকরা গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। তার আগে পর্যন্ত টাঙ্গাইল শহর ও গ্রামে জমিদার ও ধনিক শ্রেণি ব্যক্তিগত ঘোড়া ও গাধা রাখতেন। সাধারণ শ্রেণির লোকেরা টমটম নামক একধরনের ঘোড়ার গাড়ি নিজেরাও রাখতেন, আবার কখনও কখনও ভাড়া খাটাতেন। এ টমটমগুলো এখনও পুরান ঢাকা তথা গুলিস্তান, সদরঘাট অঞ্চলে দেখা যায়। এখন তা অনেকটা শৌখিন রূপ নিয়েছে। সে সময় পর্দানশীন নারী ও ধনিক সম্প্রদায়ের লোকেরা পালকি ব্যবহার করতেন। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণির নারীরা ‘ডুলী’ চড়ে যাতায়াত করতেন।
তখন নৌকার খুব ভালো চল ছিল। বিভিন্ন শ্রেণির ও আকারের নৌকা। ছোট ছোট নদী ও বিলে এ নৌকাগুলো ব্যবহার হতো। যানবাহন বলতে রণদার শৈশবে এ ছিল উপায়ান্তর। তবে ঠিক রণদা কীভাবে সেখানে পৌঁছেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধারণা করা চলে, তিনি নৌকায় চড়ে আর হেঁটে শিমুলিয়া পৌঁছেছিলেন।
কয়েক দিন আগেই মামারা শিমুলিয়া থেকে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোন মুখ নিয়ে তিনি সেখানে যাবেন? তবু তাকে যেতে হবে। বকুনি, বিয়োগ আর বেদম প্রহরের যাতনা তো তিনি বেলা-অবেলায় সয়ে চলেছেন। দুরন্তপনায় সংকোচ কোনো দিন ঠাঁই পায়নি তার গাল-চোখজুড়ে। আজ কিন্তু সংকল্পের বেয়াড়া হৃদয়, খুব ধীর আর ধাতস্থ। শিমুলিয়ায় পৌঁছলে সবাই তাকে দেখে অবাক হলেও, তিনি কিন্তু স্থির চোখেই দূর-প্রতিজ্ঞ। সেখানে কদিন থাকলেন। কেবল কলকাতার মামার বাসার ঠিকানাটা সন্তর্পণে সে হাতড়িয়ে বেড়িয়েছেন। কোনোভাবে তার হদিস তিনি পেলেন শেষ অবধি। এরপর ভোরেই রওনা হলেন কলকাতার পানে।
কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী। ১৭৭২ সালের পর থেকে ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। বাংলার মানুষ তখন অফিস, আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য সব কিছুতেই কলকাতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। তবে কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্য আর দেশীয় পথে চলল না। কেননা ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব হয়ে গেছে। এ সময়ে ভারতে চলছিল দেশীয় পদ্ধতির কারিগরি শিল্প ও বাণিজ্যব্যবস্থা। ছিল না কোনো প্রযুক্তি সুবিধা। এ সুযোগটা তখন কাজে লাগিয়েছিল ইংল্যান্ডের প্রযুক্তি সুবিধাসম্পন্ন পুঁজিপতি সমাজ। অধিকন্তু তারা দেশি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করে। উল্লেখ্য, তারা খুব দ্রুততার সঙ্গে ভারত থেকে অর্থ কামাই করতে থাকে। ফলে দেশি শিল্প উৎপাদন ও রফতানিতে ধস নামল। তখন ব্রিটিশরা ভারত থেকে স্বল্প মূল্যে কাঁচামাল কিনে ইংল্যান্ড পাঠায়। আর ইংল্যান্ডে তৈরি পণ্য ভারতের বাজারে বিক্রি শুরু করল। ভারত তথা বাংলা তখন গ্রামীণ রূপকাঠামোয় অধ-পতিত।
এ সময় ইউরোপজুড়ে মুক্তবাণিজ্যের ডামাডোল বাজতে থাকে। আর ভারতের বাজারকে তারা ইউরোপীয় বণিকদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়। ফলে তখন ভারতের নগর অঞ্চলগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়তে থাকে। প্রথমেই তারা বৈদেশিক বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা স্থাপনে লগ্নি করে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে অর্থাৎ ১৮৪৮ সালের পরে ভারতে রেললাইন চালু হওয়ার পরে দেশের শিল্পায়নের সার্বিক প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়। ফলে সুতা ও বস্ত্র, কয়লাখনি, কাগজ, লোহা ও স্টিলসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। এ শিল্প খাতগুলো উনিশ শতকের পরবর্তী অর্ধশতক ব্যাপী ভারতের অর্থবাজার শাসন করেছে।
এ শিল্পবাণিজ্যের স্বার্থে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি ও ধনতান্ত্রিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে বণিক শহর কলকাতা। তখন কোম্পানির সহযোগিতায় অর্থ উপার্জনের আশায় কলকাতা শহরে ভিড় জমাতে থাকে নবগঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দল। ফলে বড় হতে কলকাতা যাওয়া একধরনের প্রবণতা তৈরি হয়। উনিশ শতকে বাংলায় যে ‘রেনেসাঁ’ ঘটে গেল তারও কেন্দ্র ছিল এখানে। কার্যত এ রেনেসাঁর প্রভাবেই ১৮৭০ সাল থেকে স্বদেশি এন্টারপ্রাইজ ও বয়কট চিন্তার বীজ বাংলায় বপন হতে থাকে। সে বীজ থেকে চারাগাছ। তারপর ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা এক মহিরুহের রূপ লাভ করে। বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনও তাই কলকাতাকেন্দ্রিক পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তখন হুগলি নদীবন্দর, হাওড়া রেলস্টেশন, পাটকল, কাগজকলসহ বিভিন্ন মধ্যস্বত্ব¡ ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। এ কারণে সাধারণ পড়ালেখা না জানা প্রান্তিক বা অগঠিত শ্রেণির অনেকেই কলকাতা যেতেন কাজের সন্ধানে। রণদা প্রসাদ সাহাও কলকাতার দিকেই ছুটলেন।
এ সিদ্ধান্তটিকে ছোট করে দেখার জো নেই। মানুষ হিসেবে সে সময় রণদা ছোট হলেও, দুরন্তপনা আর দলবেঁধে চলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তার একাট্টা বলিষ্ঠতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিতা। এ চরিত্রের একটি সাহসী বাল্য-হৃদয় যখন দীর্ঘদিন অবধি বিয়োগ, ব্যথা, অনাদর, অসম্মান আর অপমানে জর্জরিত, ঠিক তখনই ভাতের বদলে ছাই তার রুজি হিসেবে জোগাড় হলো। এ অবমাননা তাকে শেকড় থেকে শিখরে পৌঁছার অনুরাগে আসক্ত করেছিল। তিনি তো বিমাতাকে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ‘এই রণা আর কোনোদিন তোমার বাড়িতে বোঝা হয়ে আসবে না, তোমার হাতে ভাত সে আর খাবে না।’ তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, এ জগৎ সংসারে তার আপন বলে কেউ নেই। বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিয়ে, তাকেই গড়তে হবে ধুলোয় তাজমহল।
তিনি কলকাতার পথ ধরলেন। উনিশ শতকের সেই বাংলায় কলকাতার পথটা এত সহজ ছিল না। সীমাবদ্ধ পরিবহনব্যবস্থার মাধ্যমে বালক রণদার পক্ষে কলকাতা পৌঁছানো ছিল সাত সমুদ্দর তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার মতো অবস্থা। এ সময় তার বয়স ১১ বছর। খ্রিষ্টীয় ১৯০৭ সাল। যা হোক, এ পথটি ছিল না তার কাছে পরিচিত। এর আগে কখনও তিনি কলকাতা যাননি। কোন নৌযানে সেখানে যাওয়া যায়? কত টাকা লাগে? এসবের কিছুই রণদার জানা ছিল না। একেবারে অচেনা অজানা গন্তেব্য পা বাড়ানো, কেবল এটুকুই জানা, তিনি কলকাতা যাচ্ছেন। উনিশ শতকে বাংলার যে নবজাগরণের ধ্বনি উচ্চকিত হয়েছিল, তারই অজানা পথ তিনি ধরেছিলেন।
গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com
Add Comment