স্বপ্ন নয়, সত্যি সত্যিই স্কুল খুলল!

সুলতানা লাবু: ফোন রিসিভ করেই ওয়াসিফের মা বলতে শুরু করলেন, ‘স্কুল তো সত্যি সত্যিই খুলে গেল, আপা। খবরটা শুনে আমার ছেলে তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি। তারপর যখন বুঝল সত্যিই স্কুল খুলেছে, তখন তো খুশিতে সারা বাড়ি দৌড়াচ্ছিল। স্কুলে যাওয়া নিয়ে ওর সে কী উচ্ছ্বাস! অথচ আগে স্কুলে পাঠানোর জন্য আমাকে কত যুদ্ধই না করতে হতো। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে কত বকাই না খেতে হতো ওকে। এই দেরি করে ওঠা। দেরি করে নাশতা খাওয়া। রাতে ব্যাগ গোছাতে ভুলে যাওয়া। প্রায়ই স্কুলে না যেতে চাওয়ার বায়না। আরও কত কী ঝামেলা যে ছিল ওর। অথচ আজ ওর খুশি দেখে কী যে ভালো লাগল! বারবার বলছিল, ‘কখন যে স্কুলে যাব?’ প্রথম দিন স্কুল থেকে ফিরে সে কী গল্প! স্কুলের গল্প যেন থামতেই চায় না। ও বলছিল, স্কুলটা নাকি একদম নতুন লাগছিল। এমন ঝকঝকে-চকচকে স্কুল নাকি আগে কখনও ছিল না। বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক দূরে দূরে বসতে হয়েছে। এজন্য একটু মন খারাপ অবশ্য হয়েছিল। তবুও বন্ধুদের যে দেখতে পেয়েছে, সেটা নাকি তার জন্য খুবই খুশির বিষয়। ও বলছিল, জানো মা, স্কুলের স্যার, মামা সবাই আমাদের দেখে অনেক খুশি হয়েছেন। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা মেপেছেন। স্যানিটাইজার দিয়েছেন। বারবার হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। আর বলেছেন, মাস্ক কিন্তু একদম খোলা যাবে না। এজন্য বন্ধুদের চিনতে একটু সময় লেগেছে। অনেকে তো আমাকে চিনতেই পারেনি প্রথমে। কেউ কেউ তো আমার নামই ভুলে গেছে। তবে আরও বেশি ক্লাস হলে নাকি ওর বেশি ভালো লাগত। আমি তো ওকে বলেছি, স্কুল শুরু হয়েছে এটাই অনেক। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকার কিন্তু খুব সচেতন। তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে আগেই সরকারের পক্ষ থেকে সব স্কুলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন সেনিটাইজেশনটা তো খুবই জরুরি। এই দেখুন না, আমি একাই কথা বলে যাচ্ছি। তা আপনার সন্তানও নিশ্চয়ই খুব খুশি? অনেক দিন পর স্কুলে গিয়ে কেমন লাগল নিলয়ের?’

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নিলয়ের মা ম্লান কণ্ঠে বললেন, ‘ভাবি নিলয়কে আসলে স্কুলে পাঠাতে পারিনি। এজন্য ওর খুব মন খারাপ। আমি ওকে বলেছি স্কুল খুলেছে ঠিকই, কিন্তু যেকোনো সময় স্কুল আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’

ওয়াসিফের মা রীতিমতো অবাক, ‘কী বলেন ভাবি! পরিস্থিতি খারাপ হলে তখন দেখা যাবে। এখন ওকে স্কুলে পাঠানো দরকার ছিল। সংক্রমণ নিয়ে নানা বিশ্লেষণের পরই তো স্কুল খুলল। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ৩১ আগস্টের পর ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তিনি এটাও বলেছেন, যেহেতু ১৮ বছরের নিচে এখন টিকা দেয়া যাচ্ছে না, তাই স্কুল খোলাটা সংক্রমণের হারের ওপর নির্ভর করে। সরকারের অনেক গবেষণা, বিশ্লেষণ, আলোচনা ও বৈঠকের পর এই স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর আপনি নিলয়কে স্কুলে পাঠালেন না? অফিস-আদালত, দোকানপাট, কলকারখানা, গণপরিবহন সবই খোলা হয়েছে। বাকি ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে সরকার খুবই সচেতন বলেই তো অনেকবারই স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েও স্কুল খোলা হয়নি। দেশে এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এজন্যই স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদিও সংক্রমণের হার এখন দুই শতাংশের নিচে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে সেটা তখন দেখা যাবে। স্কুল খুলেছে এটা তো সত্যি। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সারাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ১২ সেপ্টেম্বরকে নির্ধারণ করেছি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেশিরভাগ শিক্ষকই টিকা নিয়েছেন। আর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা আগের ঘোষণা অনুযায়ী হবে, অর্থাৎ নভেম্বরে এসএসসি এবং ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি চলছে।’ আর আপনি কিনা বলছেন স্কুল খোলা থাকবে তো?’

‘আসলে আমাদের সবকিছুতেই সমস্যা। প্রথমে যখন করোনাভাইরাসের আক্রমণ শুরু হলো, আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। এটাও বলেছি যে, আর কত মায়ের বুক খালি হলে স্কুল বন্ধ হবে। আর এখন…। সরকারও জানে শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব কতটা। ওদের ওপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাই যত আলোচনা-সমালোচনাই হোক না কেন, সরকার কিন্তু শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। আর এখন যখন স্কুল খুলেছে, আমি নিশ্চিন্তে ওয়াসিফকে স্কুলে পাঠিয়েছি।’

‘আসলে বিষয়টা তা নয়। স্কুলের ছুটি তো দফায় দফায় শুধু বেড়েই যাচ্ছিল। কবে যে স্কুল খুলবে, তারও ঠিক ছিল না। এক দিন নয়, দু’দিন নয়, পুরো ৫৪৩ দিন স্কুল বন্ধ ছিল। আর মাস গুনলে দাঁড়ায় ১৮ মাস। দেড় বছরের ওপর তো পেরিয়েই গেল। ছুটির দফা থেমেছে, কিন্তু নিলয়ের বড় হওয়া তো থেমে থাকেনি। ওর স্কুল ইউনিফর্ম একদমই গায়ে লাগে না। গত বছরের নতুন ইউনিফর্ম এখনও নতুনই আছে। কিন্তু…’

‘ও তো বড় হবেই। এটাই স্বাভাবিক। ওয়াসিফেরও  স্কুলড্রেস গায়ে লাগে না। তবুও স্কুলে পাঠিয়েছি। কারণ শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘গত দেড় বছরে শিক্ষার্থীরা স্কুলড্রেসের তুলনায় বড় হয়ে গেছে। এছাড়া এই মুহূর্তে স্কুলড্রেস সব অভিভাবকের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নাও হতে পারে।’ তাই স্কুল কর্তৃপক্ষকে স্কুলড্রেসের ব্যাপারে বেশি কড়াকড়ি না করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।’

‘তাই নাকি? এটা তো জানতাম না। শুনে খুব ভালো লাগল। তবুও আগামী দিন পাঠাতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না।’

‘কেন?’

‘আসলে আমার আরও কিছু সমস্যা আছে। নিলয়কে যে কীভাবে স্কুলে পাঠাই? ওর স্কুলের অনেক বেতন বাকি আছে। এমনকি এ বছরের ভর্তিটা পর্যন্ত টাকার অভাবে করাতে পারিনি। এখন তো সব মিলে আরও অনেক টাকা জমে গেছে। এতগুলো টাকা শোধ না করে কী করে ওকে স্কুলে পাঠাবো। যখন অর্থনৈতিক অবস্থা বদলাবে, তখন না হয় আবার ছেলেটার পড়াশোনা করাব। তবে ও অবশ্য ঘরে বসে লেখাপড়া করছে। এমনকি বন্ধুদের কাছ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট জোগাড় করে সেগুলো করেও যাচ্ছে।’

‘এটাও কোনো সমস্যা নয়, ভাবি। আজকে আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে কী হবে, এমনটা তো আর সব সময় থাকবে না। এই সময়টা সবারই খারাপ যাচ্ছে। হয়তো কারও একটু বেশি। আপনি এক কাজ করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আপনার সমস্যা বুঝিয়ে বলেন। প্রয়োজনে আবেদনপত্র দিন স্কুলপ্রধান বরাবর। টাকার জন্য একজন ছাত্র লেখাপড়া করতে পারবে না, তা কি হয়? এই বিষয়টাও কিন্তু সরকারের মাথায় আছে। আর এজন্যই শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষকে ফি আদায়ে মানবিক হতে হবে। তিনি বলেছেন, যেসব ফি নেয়া প্রয়োজন, সেসব ফি এখন আদায় করা যাবে। তবে যদি কোনো শিক্ষার্থী ফি দিতে অপারগ হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে মানবিক আচরণ করতে হবে।’

এছাড়া ফি পরিশোধের বিষয়ে কিস্তিতে পরিশোধ করা যায় কি না, সেটিও বিবেচনায় নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ করেছেন তিনি। তিনি যে শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ করেছেন, তা নয়। অভিভাবকদেরও একটা বিষয় মাথায় রাখতে বলেছেন স্কুল পরিচালনা, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রভৃতিও কিন্তু শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভর করে। তাই অন্যান্য খরচের সঙ্গে যাতে স্কুলের বেতন দেয়াও সম্ভব হয়, সে বিষয়েও যেন অভিভাবকদেরও চেষ্টা থাকে।’

‘তাহলে আমি কালই স্কুলে যোগাযোগ করব। বকেয়া টাকার একটা সুরাহা যদি স্কুল থেকে পাওয়া যায়, তাহলে ছেলেটার পড়াশোনা থেমে থাকবে না। বাকিটা চালিয়ে নিতে পারব।’

‘সবই ঠিক হয়ে যাবে, আপা। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখার জন্য সরকার বাড়িতে বসে অনলাইন ক্লাস ও টেলিভিশনে ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে। আর অর্থের অভাবে কেউ লেখাপড়া করতে পারবে না, তা হয় না। আর আপনার নিলয়ের মতো মেধাবী ছাত্রের লেখাপড়া তো কিছুতেই বন্ধ করা উচিত নয়। সব শিশুর মতো নিলয়েরও স্কুলে যাওয়ার অধিকার আছে। আমার তো মনে হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অনেকটা স্বাভাবিক তো হয়েই এসেছে। আবার ওরা ফিরে যেতে পেরেছে ওদের সেই চেনা ক্লাস, বেঞ্চ, বোর্ড, ঘণ্টা আর প্রিয় স্কুলের মাঠে। স্কুল-কলেজগুলোও যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নিশ্চয়ই আবার সবকিছু পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের হাসি, আনন্দ আর কলরবে মুখর হবে। প্রয়োজন শুধু আমাদের সবার সমন্বিত সহযোগিতা, সচেতনতা আর অপেক্ষা। সুদিন নিশ্চয়ই আর দূরে নয়।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০