এক দশক আগেও বিদ্যুৎ নিয়ে বেশ খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংকে জনগণ নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছিল। তবে চলতি দশকে এ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সন্দেহ নেই। এর পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে সরকারের কিছু উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। ডিজেলচালিত বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে অবশ্য উচ্চমূল্যেই বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে সরকারকে। এমন ব্যবস্থা দ্রুত বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্যই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হলো, সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি; বরং এ-সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। চাপ বাড়ছে জনগণের ওপরও। এ পরিস্থিতির অবসানে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
গতকালের শেয়ার বিজে ‘বেসরকারি খাতের ডিজেলচালিত সাত কেন্দ্রের বোঝা টানছে পিডিবি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন বেরিয়েছে। এতে বলা হয়, ডিজেলভিত্তিক বেসরকারি বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেনায় গড়ে ব্যয় হয়েছে ২০ থেকে ৩১ টাকা। অথচ গ্রাহক পর্যায়ে ছয় থেকে দশ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। আর বাল্কে (পাইকারি) চার টাকা ৮৪ পয়সা দরে তা বিক্রি করছে পিডিবি। ফলে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে বড় লোকসান
গুনতে হচ্ছে পিডিবিকে। বলা বাহুল্য, লোকসানের পুরোটাই যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। অর্থাৎ জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ অর্থের বোঝার প্রায় পুরোটাই জনগণকে বহন করতে হচ্ছে, যা কাম্য নয়।
স্বল্পমেয়াদে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতেই মূলত বেসরকারি উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। সে সময় মূলধারার তথা রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বৃদ্ধির পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। দুঃখজনক হলো, সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এ খাতে এখনও বরং বিপুল অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে পিডিবিকে। এর বড় অংশই যাচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ, যা কেন্দ্রভেদে মেগাওয়াটপ্রতি মাসে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার ডলার। এমনকি ওভারহলিংয়ের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলে কিংবা কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা না হলেও এ চার্জ দিতে হয়। সঙ্গে আরও কিছু চার্জ রয়েছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে এর উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি, যার ভার পিডিবি তথা সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে।
এতে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হচ্ছে পিডিবি—এমন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি এ কেন্দ্রগুলোর অনুমোদন নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। এদিকে উচ্চমূল্যের বিদ্যুতের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপাতে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে এর। এতে জনগণের জীবনমানেও প্রভাব পড়ছে। দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলে অভিমত অনেকের।
আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ডিজেল কিংবা ফার্নেস অয়েলের মতো দামি জ্বালানির ওপর নির্ভরতা। এর পরিবেশগত বিরূপ প্রভাবও রয়েছে। অথচ শুরুতে কয়লা কিংবা গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাশ্রয়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। তার বাস্তবায়ন হয়নি। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারেও আমাদের নির্ভরশীলতা রয়েছে। সেখানে তেলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যুতে বেসরকারি খাতের ওপর অতি নির্ভরশীলতায় নিরাপত্তা ঝুঁকিও রয়েছে। এ পরিস্থিতির অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি ও বেশি ব্যয়ের জ্বালানি নির্ভরতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এজন্য জাতীয় পর্যায়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগও তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনেও জোর দিতে হবে। দুঃখজনক হলো, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের উদ্যোগ এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। এ বিষয়ে সরকার দ্রুত ও যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেই বিশ্বাস।