রোহান রাজিব: দেশের ডলার সংকটে চাপ কমাতে নানা উপায়ে বিদেশি ঋণ বাড়াতে চাচ্ছে সরকার। তবে আশানুরূভাবে তা বাড়াতে পারছে না। বরং বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নেয়ার চেয়ে পরিশোধ হচ্ছে বেশি। এতে রিজার্ভের ওপর আরও চাপ তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতেও চাপ তৈরি করেছে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ।
চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বেসরকারি খাত যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছে, তার চেয়ে চার দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার বেশি পরিশোধ করেছে। গত নয় মাসে ১৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পেয়েছে বেসরকারি খাত। একই সময়ে সুদ ও মূল ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২৩ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর থেকে ডলার বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, যা এখনও কাটেনি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি ঋণ বাড়াতে বেশকিছু পরিকল্পনা করেছে। তার মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে ঋণ নেয়ার জন্য চুক্তি করেছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বাড়াতে চেষ্টা করছে। তবে ডলারের বাজারে এখনও অস্থিরতা থাকার কারণে বেসরকারি খাত স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে কম। বরং নতুন ঋণ নেয়ার চেয়ে আগের ঋণ পরিশোধে বেশি মনোযোগী ব্যবসায়ীরা।
অপরদিকে অনেক উদ্যোক্তা এখন ঋণ নিতে চাইছেন না। কেননা বছর দুয়েক আগে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়া যেত। গত দুই বছরে সুদহার অনেক বেড়ে এখন ৯ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এ সময় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৫ শতাংশের মতো। আগামীতে ডলারের দর বা সুদহার কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না। যে কারণে অনেকে ঋণ নিতে চাইছেন না। তাই নতুন ঋণ আসার পুরোনো ঋণ পরিশোধ হচ্ছে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বেসরকারি খাত ৩৭ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পেয়েছে। একই সময়ে সুদসহ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর পরিশোধের চেয়ে ঋণ এসেছিল বেশি। তবে চলতি বছর সে প্রবণতা উল্টোমুখী।
তথ্যমতে, বেসরকারি খাতের ঋণের সুদ পরিশোধ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার বৃদ্ধির কারণে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের পুরো সময়ে সুদ পরিশোধ হয়েছে ২৪৬ মিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে পরিশোধ হয়েছে ৪৭৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৯ মাসে সুদ পরিশোধ আগের পুরো বছরের চেয়ে ২৩২ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের জন্য সর্বোচ্চ সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) সহ ৩ শতাংশ সুদ প্রদান করতে হবে। বর্তমানে, এসওএফআর ৫ শতাংশের ওপরে দাঁড়িয়েছে, যা এক সময়ে ছিল ১ শতাংশেরও কম। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
বেসরকারি খাতের ঋণ পরিশোধে চাপ রিজার্ভে পড়েছে। কারণে আমদানি দায় ও ঋণ পরিশোধের জন্য গত ১৬ মাসে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রিজার্ভ কমে এখন ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে যেখানে রিজার্ভ উঠেছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৯ মাসে মাসে ৩ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার (নিট) ঋণ পরিশোধ হয়েছে। যদিও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালের নিট ঋণ ৯৫৫ মিলিয়ন ডলার বেড়েছিল।
তথ্য অনুযায়ী, স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে দ্রæত কমছে বায়ার্স ক্রেডিট। ৯ মাসে বায়ার্স ক্রেডিটের পেমেন্ট প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার কমেছে। বর্তমানে বায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি রয়েছে ৬ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। বায়ার্স ক্রেডিট হচ্ছে দেশের আমদানিকারকের বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় নেয়া ঋণ। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণ নিয়ে থাকেন।
বর্তমানে স্বল্পমেয়াদি বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে আরব আমিরাতে। এ ঋণের পরিমাণ ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এরপর সিঙ্গাপুরে ২ দশমিক ০৯ বিলিয়ন এবং হংকং ও যুক্তরাজ্যে এক বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ রয়েছে।
উল্লেখ্য, করোনা শুরুর পর বিশ্ববাজারে সুদহার তলানিতে নামে। তখন বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেশ বেড়ে যায়। এখন এসব ঋণ পরিশোধের চাপ তৈরি হয়েছে। করোনার আগের বছর ২০১৯ সাল শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণস্থিতি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের শেষে তা বেড়ে ১৬ দশকি ৪১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। মাত্র দুই বছরেই ঋণ বাড়ে ৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।