জালিয়াতি করে সম্পদ বাড়াচ্ছে স্বল্প মূলধনি লিবরা ইনফিউশন

পলাশ শরিফ: ঋণের তথ্য গরমিল ও বিতর্কিত পাওনাকে সম্পদ দেখাচ্ছে লিবরা ইনফিউশন। এভাবে মোট সম্পদ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে কোম্পানিটি। সম্পদ বৃদ্ধির তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে স্বল্প মূলধনি ওই কোম্পানির শেয়ার কিনছেন বিনিয়োগকারীরা। এর সুযোগ নিয়ে কারসাজি করে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা গত এক মাসে শেয়ারদর প্রায় ১৩৫ শতাংশ বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, স্বল্প মূলধনি লিবরা ইনফিউশন শেয়ার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সর্বশেষ এক হাজার ২২৫ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এক মাস আগেও কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৫২২ টাকা ৯০ পয়সা। এ হিসেবে এ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারদর প্রায় ৭০২ টাকা বা প্রায় ১৩৫ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি আর্থিক বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এক কোটি ৫৮ লাখ টাকা লোকসানে থাকার পরও শেয়ারদর অস্বাভাবিক বাড়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর জের ধরে এক মাসের ব্যবধানে দু’দফায় নোটিস পাঠিয়েছে ডিএসই, যার জবাবে ‘কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই’ বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি। দর বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে ‘মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে উদ্যোক্তা ও পরিচালকরাই শেয়ারদর বাড়ানোর নেপথ্যে ভূমিকা রাখছেন’ বলে তথ্য মিলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সম্পদের তথ্যে জালিয়াতি ও শেয়ার কারসাজির অভিযোগ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানি সচিব শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শেয়ারের দাম কেন বাড়ছে সেটা বিনিয়োগকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা এ বিষয়ে কিছু জানি না। এর পেছনে কোম্পানির কারও কোনো হাত নেই। আর ঋণ-সম্পদের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি লিবরা ইনফিউশনের প্রান্তিক প্রতিবেদনে প্রায় ৪৫৫ কোটি টাকা সম্পদ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৮১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা স্থায়ী সম্পদ। অথচ কোম্পানিটি ২০১০ সালে শেষবার সম্পদের মূল্যায়ন করেছে। গত সাত বছরে ওই সম্পদের মূল্যের তারতম্য হলেও পুরোনো পরিমাণই বারবার উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ওই সম্পদের একটি অংশের অবচয় প্রায় ১১৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হলেও তা বাদ দেওয়া হয়নি। এভাবে লিবরা ইনফিউশনের স্থায়ী সম্পদের তথ্য উত্থাপনে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে বলেও তথ্য মিলেছে।
স্থায়ী সম্পদের পাশাপাশি ঋণের হিসেবেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে লিবরা ইনফিউশন। বেসরকারি আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের হিসাবে গরমিল করেছে কোম্পানিটি। চলতি মূলধন জোগানো ও কারখানা সম্প্রসারণের জন্য ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় স্বল্প মূলধনি কোম্পানি লিবরা ইনফিউশন। ঋণ নেওয়ার কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি। খেলাপি ঋণ আদায়ে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজন মামলাও করেছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকের হিসেবে সর্বশেষ ওই ঋণের পরিমাণ ১০৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ কোম্পানির পক্ষ থেকে ২২ কোটি টাকা কমিয়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে ৮৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বকেয়া ঋণ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ঋণখেলাপির তকমা মুছে ফেলতে ব্যাংকের ওই ঋণকে ‘বিনিয়োগ’ বলে দাবি করছে লিবরা ইনফিউশন। অথচ ওই বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যাংককে কোনো মুনাফা দেয়নি কোম্পানিটি।
এদিকে ব্যবসায়িক লোকসানের জন্য আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংককে দায়ী করে ব্যাংকের কাছে ১৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা পাওনা দেখিয়েছে লিবরা ইনফিউশন। এ নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে মামলাও চলছে। আর বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আর্থিক প্রতিবেদনে ওই পাওনার পরিমাণকে সম্পদ হিসেবে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। তার পরও ওই পাওনাকে চলতি সম্পদ হিসেবে দেখিয়েছে কোম্পানিটি।
লিবরার ঋণ বিষয়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা জালাল আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘লিবরা ইনফিউশনের বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি রয়েছে। ঋণ আদায়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩টি মামলা চলমান রয়েছে। এখন তারা যদি উল্টো ব্যাংকের কাছেই টাকা পাওয়ার কথা বলে তার ব্যাখ্যা ওই কোম্পানিই দিতে পারবে। আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ব্যাংকঋণের তথ্যে গরমিল ও স্থায়ী সম্পদের হিসেবে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সম্পদ বাড়িয়ে দেখিয়েছে লিবরা ইনফিউশন। বিদ্যমান নিয়ম মেনে সম্পদ মূল্যায়ন ও সম্পদের অবচয় বাদ দেওয়া হলে এবং ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সঠিকভাবে উত্থাপন করা হলে লিবরা ইনফিউশনের সম্পদের পরিমাণ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে যাবে। তাই কোম্পানিটির ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরের প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে আপত্তি জানিয়েছে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোম্পানি। আপত্তির পরও সম্পদ বাড়তে দেখে ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ঠকছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত লিবরা ইনফিউশনের পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। ‘এ’ ক্যাটেগরিতে থাকা কোম্পানিটির ১২ লাখ ৫৬ হাজার শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ৩৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫১ দশমিক ৭১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। সর্বশেষ আর্থিক বছরে মাত্র ৬০ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে লিবরা ইনফিউশন। এর বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০