স্বাধীনতার সোপান: ভাষা আন্দোলন

কাজী সালমা সুলতানা: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’রক্তে রাঙানো সেই ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু হলো। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে গৌরবোজ্জ্বল। পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল, যা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃত। তারই পথ ধরে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতে থাকেন।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও পরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য রাজনীতিবিদ কমরুদ্দিন আহমেদ ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের ঘোষণায় বলা হয়Ñ‘মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যুগোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সামনে রেখে প্রথম এগিয়ে আসে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এর আগে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জোর প্রচেষ্টা চালান। শুরু হয় ছাত্রবিক্ষোভ।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন। এই অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সেদিন পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবের সংশোধনী এনে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানসহ কেন্দ্রীয় নেতা এবং পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বিরোধিতা করলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবি বাতিল হয়ে যায়।

এ খবর ঢাকায় পৌঁছালে ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তৈরি হয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পরিচালনা করার এই পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত হন শামসুল আলম। এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন। ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থান পায়। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন এবং একাত্তরের ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০