রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: ১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর সকালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা হানাদার মুক্ত করে প্রথম স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন যারা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন সাহসী বীর সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মতি। দেশের জন্য যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনলেও এখনো চলছে তার জীবন যুদ্ধ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ এগিয়ে গেলেও ব্যক্তিজীবনে পিছিয়ে আছেন তিনি । সরকারের দেয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া আর কিছুই মিলেনি তার কপালে। নিজের জমি না থাকায় মুক্তাগাছার পৌর শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সরকারি খাস জমির এককোণে ঝুপড়ি ঘরে স্ত্রী, ব্রেন স্ট্রোক করা ছেলে ও ছেলের বউ এবং নাতি-নাতনীকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই বীর যোদ্ধা।
পৌর শহরের তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে ব্রেনস্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছেন ছোট ছেলে কামাল উদ্দিন (৪৩)। বিছানায় শুয়ে ছলছল চোখে একপলক তাকিয়েই রইল কামাল। তার চোখে-মুখে রয়েছে নিদারুণ কষ্টের ছাপ। কি যেন বলতে চায় সে। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারেনি। কামালের রয়েছে স্ত্রী ও তিন মেয়ে। বড় মেয়ে শরিফা আক্তার ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্রী। ছেলের অসুস্থতার কারণে অনার্স পড়ুয়া নাতনীর লেখাপড়ার খরচ যোগান দিতে হয় বীর যোদ্ধা মতিকেই।
অসহায় চোখে মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘যুদ্ধ করেছিলাম দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, কোন কিছু পাওয়ার আশায় না। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জমি-ঘর দিয়েছে কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমার ভাগ্যে এক টুকরো জমি জোটেনি। যাও সরকারি একটু খাস জমিতে থাকি, তাও আতংকে থাকি কখন ওঠে যেতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে ভাতা মেলে তা দিয়ে ছেলের চিকিৎসা ও নাতনীর পড়ালেখার খরচ চালিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অর্থাভাবে এখন ছেলেকেও চিকিৎসা করাতে পারছি না। ১৬ ই ডিসেম্বর এলেই আমাদের কথা মনে পড়ে নেতাদের, বাকি সময় কেউ খোঁজ রাখেনা।’
সংসার জীবনে এই মুক্তিযোদ্ধা মতিউরের পরিবারে রয়েছে স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৯), দুই ছেলে আলাল উদ্দিন (৪৩) ও কামাল উদ্দিন (৪০) এবং এক মেয়ে মাজেদা খাতুন (৩২)।
একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বীরের বেশে বিজয়ী ছিনিয়ে এনেছিলেন ঠিকই কিন্তু জীবন যুদ্ধে কি তিনি জয়ী হতে পারবেন জানতে চাইলে একটু মৃদু হেসে শেয়ার বিজকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মতি বলেন, আল্লাহ এতদিন চালিয়েছেন বাকি দিনগুলোতেও তিনিই চালিয়ে নিবেন। কিছু পাবার আশায় তো যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করিনি। দেশকে শোষণ ও জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে এবং স্বাধীন সার্বভৌমত্ব ভূখন্ড অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ হবে একটি শোষণমুক্ত আর্থসামাজিক উন্নয়ন সমৃদ্ধ দেশ। এখন অর্থের অভাবে ছেলেকে পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারছিনা। ছেলে বিছানায় পড়ে আছে। আমি আজও অবদি জীবনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছি। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল, উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের কেউ কোনো খবর নেননি বলে আক্ষেপ করে চোখ মুছতে থাকেন মতি।
এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আবুল কাসেম শেয়ার বিজকে জানান, তার (মতি) বিষয়ে আমি জানি, সে একটি খাস জমিতে থাকে, এখন তো কোন বরাদ্দ নেই, সামনে বরাদ্দ আসলে দেখি কি করা যায়।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পূনর্বাসন করতে পেরেছি। সামনে বরাদ্দ আসলে বাকিদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করবো।
উল্লেখ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মতি, ভারতের তোরা নামক অঞ্চল থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে ১১ নাম্বার সেক্টরে কর্ণেল আবু তাহের ও কর্ণেল শফিউল্লাহ’র অধীনে ময়মনসিংহের ভিটিবাড়ী, বটতলা, গাবতলিসহ মুক্তাগাছার বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।