Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:30 am

স্বাধীনতার ৫০ বছরে আবাসন খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি

রেজাউল করিম সিদ্দিকী : স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। প্রায় দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসন ও ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের পর একটি ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল ও দুর্বল অর্থনীতির দরিদ্র দেশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যাত্রা শুরু করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। সুদীর্ঘ শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের ফলে বাঙালি জাতি ছিল অনেকটা হতাশাগ্রস্ত ও দিকভ্রান্ত। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশের মানুষ তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে। জাতির পিতা কিসিঞ্জারের সেই তলাবিহীন ঝুড়িকে একটি সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার চেষ্টা ছিল দেশি-বিদেশি চক্রান্তের একটি অংশ। এ বছর আমরা স্বাধীনতার জয়ন্তী উদ্যাপন করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের সব স্তরের মানুষ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশ ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, পাট উৎপাদনে প্রথম, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থান অর্জন করে বিশ্বে কৃষি উৎপাদনে রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে কভিড প্রতিকূলতার মাঝেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনায় বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণ কর্মী, মাঠ পর্যায়ের কৃষক-কৃষানিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বোরো উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫০৮ মেট্রিক টন, যা দেশের বোরো উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বিভাগ, দপ্তর সংস্থার সহযোগিতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩৮৬.০৭৮ লাখ মেট্রিক টন চাল, ১২.৩৪৪ লাখ মেট্রিক টন গম, ৫৬.৬৩১ লাখ মেট্রিক টন ভুট্টাসহ মোট ৪৫৫.০৫৩ লাখ মেট্রিক টন দানাদার শস্য উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়া ৯.৩৯১ লাখ মেট্রিক টন ডালজাতীয় ফসল, ১১.৯৯৫ লাখ মেট্রিক টন তেলজাতীয় ফসল, ১০৬.১২৮ লাখ মেট্রিক টন আলু, ৩৩.৬২ মেট্রিক টন পেঁয়াজ এবং ৭৭.২৫১ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে।  (সূত্র: কৃষি মন্ত্রণালয়)

স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশে খাদ্য ঘাটতির কারণে প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিনের ন্যূনতম খাদ্য চাহিদার ৬০ শতাংশই থাকত অপূর্ণ। বর্তমানে দেশের পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পের উন্নয়নের ফলে সব নাগরিকের আমিষের চাহিদা স্থানীয়ভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে দেশে বর্তমানে শতকরা ৭৪ শতাংশের বেশি মানুষ শিক্ষিত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত হতে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, ভৌত অবকাঠামোসহ অর্থনৈতিক, সামাজিক, উন্নয়নের সব সূচকে গত অর্ধ শতাব্দীতে বিশেষ করে গত এক যুগে দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। একই সঙ্গে এই সময়ে দেশের আবাসন খাতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশের শতকরা ৮৫ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করত। বাসস্থানের জন্য তারা বাঁশ, কাঠ, খড়, ছন, গোলপাতা, পাটখড়ি প্রভৃতি নিন্মমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করত। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ মধ্যাঞ্চলের কিছু এলাকায় মাটির দেয়ালের প্রচলন ছিল। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা বা অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্যোগে প্র্রায়ই মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করত। তাছাড়া নদী ভাঙনের ফলে ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ত। আশ্রয়হীন, ভবঘুরে ও ছিন্নমূল মানুষের বসবাসের জন্য স্থায়ী আবাসনের জন্য প্রথম উদ্যোগ নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি রাজধানীর মিরপুরে বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় এদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এই উদ্যোগকে আরও যুগোপযোগী ও বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়নের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি জেলায় নির্দিষ্ট ব্যারাকে আশ্রয়হীন ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়। জুন, ২০২০ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় যার জমি আছে ঘর নেই এরূপ দেড় লাখেরও বেশি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলার খুরুশকুলে বাস্তবায়ন করা হয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় ৫ তলাবিশিষ্ট ১৩৯টি ভবন নির্মাণ করে মোট ৪,৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মুজিববর্ষে সরকার ১ লাখ ভূমিহীন, গৃহহীন পরিবারকে ভূমি ও গৃহ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে এবং তার সিংহভাগ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে গ্রামাঞ্চলে ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষের বাসস্থানের সংস্থান হয়েছে। অন্যদিকে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নির্মিত ঘরবাড়ির ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী লোকসংখ্যা ৯৩ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে। গ্রামে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই এখন পাকা কিংবা সেমিপাকা ঘরে বসবাস করে। বাঁশ, কাঠ ও ছনের ছাউনি দেয়া ঘর এখন গ্রামাঞ্চলেও বিরল। গ্রামাঞ্চলে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ইট-সিমেন্ট নির্মিত ফ্লোরে কাঠ ও ঢেউটিনের চালা দেয়া ঘর। গত অর্ধ শতাব্দীতে দেশের আবাসন খাতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে তার সিংহভাগ হয়েছেন নগরকেন্দ্রিক। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার কোনো অস্তিত্বই ছিল Dhaka Improvement Trust Authority, DIT (বর্তমানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) সীমিত পরিসরে কিছু আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ইজারা দেয়। ফ্ল্যাট বাণিজ্যের ধারণা এদেশে তখনও বিকাশ লাভ করেনি। ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মিত বহুতল ভবনের সংখ্যা তখন ছিল একেবারেই নগণ্য। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এসে দেশের রিয়েল এস্টেট ও ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক প্লট ও ফ্ল্যাট নির্মিত হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বহুসংখ্যক আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা দুই কোটি অতিক্রম করেছে, যা ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ছিল মাত্র ১৬ লাখ। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসনের চাহিদা পূরণে সরকার সরাসরি বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। এছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভূমি উন্নয়ন ও ফ্ল্যাট নির্মাণের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করেছে। একই সঙ্গে রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা জেলার সংযোগস্থলে ৬ হাজার ২২৭ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তুলেছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট সিটি পূর্বাচল নতুন শহর।

রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাসহ প্রত্যেকটি বিভাগীয় ও জেলা শহরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবে ও নির্দিষ্ট মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী করা হচ্ছে যেন ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার ও পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া রাজধানীর পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং আগামী জানুয়ারি মাসে চূড়ান্ত গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে স্বাধীনতার প্রাক্কালে যে জরাজীর্ণ, ঘনবসতিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর রাজধানী আমরা দেখেছি তার আমূল পরিবর্তন হবে এবং রাজধানী ঢাকা হবে আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও একটি তিলোত্তমা নগরী।

৫০ বছর একটি দেশের ইতিহাসে খুব একটা বেশি সময় নয়। এই স্বল্প সময়ে দারিদ্র্যপীড়িত, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ তার ভাগ্য পরিবর্তনে কতটা সফলতা অর্জন করতে পারে বাংলাদেশ তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সব সূচকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন সত্যিই অকল্পনীয় ও ঈর্ষণীয়। একই সঙ্গে দেশের আবাসন খাতে যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি গত ৫০ বছরে হয়েছে তা বিশ্বের অনেক দেশের কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পিআইডি নিবন্ধন