শরীফ ইকবাল রাসেল, নরসিংদী: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নর-নারী। তাদের মধ্যে একজন নরসিংদীর বেদনা দত্ত। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাইয়েছেন। সাহায্য করেছেন নানাভাবে। এর জেরেই পাকিস্তানীদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বেদনা দত্তকে। স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ৫০টি বছর যার খোঁজ কেউ নেয়নি, সেই বেদনা দত্তই পাচ্ছেন বীরাঙ্গনার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠনিকভাবে দেয়া হচ্ছে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। আর স্বীকৃতি পেয়ে খুশি বেদনা দত্তসহ প্রতিবেশীরাও।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হয়েছেন দেশের ৩০ লাখ বীর বাঙ্গালী। ইজ্জত হারিয়েছেন প্রায় ৩ লাখেরও বেশী মা-বোন। তাদের মধ্যে একজন নরসিংদীর পলাশের জিনারদী বরিবাড়ি এলাকার বেদনা দত্ত। যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিবাহিনীদের রান্না করে খাওয়াতেন, তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। যুদ্ধের সময় জিনারদী বরিবাড়ি রেল ব্রিজের নীচে পাকিস্তানীদের ক্যাম্প ছিলো। ক্যাম্পে থাকা সিরাজ নামে এক রাজাকারের চোখ পড়ে বিধবা বেদনা দত্তের উপর। ঘরে ছোট্ট তিনটি শিশু সন্তান তার উপর আবার ইজ্জতের কথা চিন্তা করে রাজি না হওয়ায় বেদনাকে তুলে দেয়া হয় পাকিস্তানীদের হাতে। নরপশুরা তাকে ৩দিন ক্যাম্পে রেখে পাশবিক নির্যাতন করে। পরে মৃতভেবে জঙ্গলে ফেলে দেয়। অবশেষে ৪দিন পর কৌশলে বাড়ি ফেরেন তিনি। গ্রাম্য চিকিৎসকের সহায়তায় কিছুটা সুস্থ্য হয়ে অবহেলা, বঞ্চনা আর লোক লজ্জায় সন্তানদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান বেদনা। শরীরের বিভিন্ন অংশে, কপালে ও মুখে আজও ক্ষতচিহ্ন দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তিনি।
শেয়ার বিজকে বেদনা দত্ত জানান, ‘দীর্ঘদিন পর নিজ বাড়িতে এসে বীরাঙ্গনার মেয়ে হওয়ায় জোসনা দত্ত নামের মেয়েটিকে বিয়ে দিতে পারেননি। যার ফলে মেয়েটিও আজ পাগল প্রায়। বাড়িতে এসে অন্যের বাড়িতে কাজ করে ও লতা-পাতা খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন বেদনা। সম্প্রতি সরকারীভাবে প্রাপ্ত ভিজিডি চালই তার একমাত্র ভরসা।
বেদনা দত্তের আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসনের সুপারিশক্রমে সরকার বেদনা দত্তকে বীরাঙ্গনা হিসেবে গেজেটভূক্ত করেন। আর এবারের বিজয় দিবসে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছেন। দীর্ঘ ৫০বছর পর হলেও তাকে স্বীকৃতি দেয়ায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান বেদনা দত্ত ও প্রবিবেশীরা।
প্রতিবেশীদের দাবী, যেই বেদনা দত্ত দেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য সাহায্য করতে গিয়ে এতো নির্যাতন সহ্য করেছেন তাকে যেনো পূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়। তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করেছেন। বিল থেকে লতাপাতা এনে দিন পার করেছেন। তিনি আজ বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পাওয়ায় আজ এলাকাবাসীর ধন্য।
জিনারদী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান উদ্দিন পাঠান বলেন, বেদনা দত্ত যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও বিভিন্ন কারনে তাকে যথা সময়ে তালিকাভুক্ত করতে না পারাটা লজ্জাজনক। তবে যেহেতু তাকে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে তার জন্য সরকারকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
স্থানীয় জিনারদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম গাজী বলেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা আগে আমরা জানতাম না, যখনই জেনেছি তখনই তাকে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাউলের কার্ড করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত করার জন্য সার্বিক সহায়তা করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন পর হলেও বেদনা দত্তকে এবারের বিজয় দিবসে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দিতে পেরে নিজেকে গর্ববোধ করেন পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা আফসানা চৌধুরী। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, বেদনা দত্তের তালিকাভুক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা কমিটি যাচাই বাছাই করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে মন্ত্রণালয় তাকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দিয়ে একটি গ্যাজেট প্রকাশ করেছেন।
পলাশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ জাবেদ হোসেন বলেন, বেদনা দত্তকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে আবারো প্রমান হলো এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার। যার ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মৃক্তিযোদ্ধাদের উপযুক্ত সম্মান দিয়েছেন। আর এই বেদনা দত্তকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে বেদনা দত্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি লাভে গর্বিত এলাকাবাসী, গর্বিত স্থানীয় প্রশাসন। আর বেদনা দত্তের মতো আরো যারা রয়েছেন তালিকার বাইরে তাদের খোঁজ বের করে সরকার তাদের স্বীকৃতি দেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।