Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 10:23 pm

স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা

কাজী সালমা সুলতানা: ১৪ মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৪ মার্চ ছিল শেষ দিন।  জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর চার দফার পূর্বশর্ত মেনে নেওয়ার দাবিতে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী সংগঠন এবং যুব মহিলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন সকালে আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ওয়ারীপন্থি ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন।

বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে রুদ্ধদ্বার প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে আলোচনাকালে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামানসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনের জন্যই আমাদের সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতে এক বিবৃতিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে নতুন নির্দেশ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করা যাবে না। আমরা অজেয়, কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।

বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে সকালে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ শেষে মিছিলসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার হাতে একটি আবেদনপত্র দেওয়া হয়। তাতে নেতারা যে কোনো নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান।

করাচিতে নিশাত পার্কে পিপলস পার্টির উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় পিপিপির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো  পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান।

বরিশালে এক জনসভায় বাংলা জাতীয় লীগপ্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অস্থায়ী সরকার গঠন করার আহ্বান জানান।

১১৫ নং সামরিক নির্দেশের প্রতিবাদে দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা নগরীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে তারা ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বর্তমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশের জন্য খাদ্য শস্যবাহী ‘মন্টেসেলো ভিক্টরি’ নামের আরেকটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ‘ওসান এন্ডুরাস’ নামের সমরাস্ত্রবাহী আরেকটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০ নং জেটিতে নোঙর করে বন্দর শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে ৯ মার্চ ১৬ নং জেটিতে সমরাস্ত্রবাহী অপর জাহাজ ‘সোয়াত’ জাহাজের সমরাস্ত্র খালাসের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়।

প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিটেজ হরাইজন’-এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরে পরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানান।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে।

বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ঢাকার কবি-সাহিত্যিকরা কয়েকদিন আগে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন করে। এদিন বিকাল ৫টায় বাংলা একাডেমিতে এ সংগঠনের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আহমদ শরীফ। বক্তব্য রাখেন রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, রাবেয়া খাতুন, আহমদ ছফাসহ অনেকে। সভা শেষে একটি মিছিল বের হয়ে শহীদ মিনারে শেষ হয়। এ সংগঠনের আহ্বায়ক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, বদরুদ্দিন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, আবদুল গনি হাজারীসহ অনেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

বিভিন্ন শিল্পী সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ পরিষদের সদস্যদের মধ্যে সভাপতি আলী মনসুর, সম্পাদক সৈয়দ আবদুল হাদী এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন লায়লা আর্জুমান্দ বানু। সদস্য ছিলেনÑমোস্তফা জামান আব্বাসী, জাহেদুর রহিম, ফেরদৌসী রহমান, বশির আহমেদ, খান আতাউর রহমান, বারীন মজুমদার, আলতাফ মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা, কামরুন হাসান, অজিত রায়, হাসান ইমাম, কামাল লোহানী, জিএ মান্নান, আবদুল আহাদ, সমর দাস, গহর জামিল, রাজ্জাকসহ অনেকে।

তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও  শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গ্রন্থ।