স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক কাজী আরেফ আহমেদ

কাজী সালমা সুলতানা: যে জাতি তার পূর্ব পুরুষের বীরত্বগাথা এবং ত্যাগের কথা জানে না; সে জাতির জাতীয়তাবোধ এবং দেশাত্মবোধ তিল মাত্র জন্মাতে পারে না। সে জাতি পৃথিবীতে কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। তাই আজ দেশের ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের উচিত নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন নেতা ও সংগঠকদের উচিত সেই ইতিহাস রচনায় সহযোগিতা করা। আর স্বাধীনতা আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের উচিত নিজেদের কৃতিত্ব উপস্থাপনের পাশাপাশি অন্যের অবদানকে খাটো বা অস্বীকার না করে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় সচেষ্ট হওয়া (কাজী আরেফ আহমেদ)।

বাঙালি জাতীয় সংগ্রাম ও উম্মোষের অধ্যায় থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের প্রথম কাতারের যোদ্ধা কাজী আরেফ আহমেদ। আজ থেকে ২৩ বছর আগে ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কালিদাসপুরে সন্ত্রাসবিরোধী এক জনসভায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন এই সংগ্রামী বীর।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যে ক’জন নেতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, কাজী আরেফ আহমেদ তাদের অন্যতম। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও এর পরপরই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সে সময় রাজনীতির একটাই লক্ষ্য ছিল; তা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চাঙ্গা করা এবং একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির নিজস্ব জাতীয় রাষ্ট্র নির্মাণের প্রেক্ষাপট তৈরি করা।

১৯৬২ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠিত হয়। সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে তিনি এর ‘নিউক্লিয়াস’ গড়ে তোলেন। একই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাঙালির স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন।

নিউক্লিয়াসের সদস্য হওয়ার কারণে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ যেসব কর্মসূচির সঙ্গে তিনি  যুক্ত ছিলেন তার মধ্যে ১. পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামকরণ সমর্থন,  ২. স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তৈরি, ৩. ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে নির্ধারণ করা, ৪. স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি, ৫.  স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণ, ৬. শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করা, ৭. কর্নেল এ জি ওসমানীকে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি করা,৮. ব্যক্তিগত গাড়ি ও সাধারণ যানবাহনের নম্বর প্লেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটের নামফলক ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় লেখা শুরু করা, ৯. তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, পিন্ডি না ঢাকা ঢাকা ঢাকা, ছয় দফা না এক দফা-এক দফা এক দফা এমন অনেক স্লোগান তৈরি করে প্রচার করা।

১৯৬৪ সাল থেকে কাজী আরেফ তার বাসভবন ১৪/৩ অভয় দাস লেনের ঘরে এই নিজ হাতে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে স্বাধীনতার ইশতেহার ছাপতেন ও সারারাত ধরে ঘরে ঘরে বিলি করতেন। সে ইশতেহার পড়ার পর পুড়িয়ে ফেলা হতো।

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দেবার আগেই সংগঠনের কার্যক্রম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ‘নিউক্লিয়াস’-এর অন্যতম শুভাকাঙ্খী ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে তিনি বলেন, ‘বাঙালি জাতিসত্তাকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। তার সাংগঠনিক ক্ষমতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী)। বলতে গেলে ষাটের দশকটাই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের সময়।’

আরও বলেন, ‘এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের হাতিয়ার ছিল জাতীয়তাবাদ। এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনুপ্রেরণা ছিল জয়বাংলা। এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক  রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই মুক্তিযুদ্ধে একক নেতৃত্বে ছিল সে দিনের জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটাই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস।

১৯৬৩ সালে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি হন কাজী আরেফ। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা দিলে তারই নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর শাখার ছয় দফার সমর্থন করে ঢাকার রাজপথে মিছিল করেন। ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিজেকে অনিবার্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেন। 

মুক্তিযুদ্ধকালে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গঠিত হলে তিনি পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরের উপ-অধিনায়কও বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর ৪টি সেক্টরের সঙ্গে হাইকমান্ডের একজন হিসেবে সমন্বয়ের দায়িত্বও মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিএলএফ দেশের অভ্যন্তরে ২০ হাজারের বেশি ছাত্র যুবককে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়।

কাজী আরেফ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে  জনযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার ভাষায়, ‘নিজের অধিকার আদায়ের জন্য জনগণ যে যুদ্ধ করে, যে যুদ্ধ কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণির স্বার্থে নয়, সে যুদ্ধই হলো জনযুদ্ধ।’ (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ফেব্রুয়ারি-১৯৯৯)

কাজী আরেফ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম রূপকার। তিনি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা করেন। প্রাথমিকভাবে সেদিন এটা জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা বলা হলেও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে চূড়ান্ত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৭২ সালে গঠিত দেশের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি বলেন, ‘তখন একটা পরিস্থিতি ছিল, সরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের সরকার। কাজেই আমরা মনে করেছিলাম তখন গণতন্ত্র নিশ্চিত থাকবে। একটি অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকবে, যা সেই সরকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সেই সাংবিধানিক ভিত্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হইনি। আমরা তখন সাংবিধানিক ভিত্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করছিলাম। অর্থাৎ পরের অংশটার (সমাজতন্ত্রের) জন্য। (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ফেব্রুয়ারি-১৯৯৯)

কাজী আরেফ আহমেদের চেতনাজুড়ে ছিল মানুষের মুক্তির গান। তার জীবন ছিল লক্ষ্যপূর্ণ শুধুই দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য নিবেদিত।

তার মতে , ‘আসলে আমরা যে জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, জনগণ যে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিল সেই স্বাধীনতার যুদ্ধ একটি মানচিত্র বা একটি পতাকা পাওয়ার জন্য ছিল না। জনগণের মুক্তি ছিল সবচেয়ে বড় কথা। এই মুক্তি অর্থনৈতিক উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রীয় মুক্তি। এই মুক্তির মধ্যে সবকিছুই জড়িত ছিল। এই মুক্তি শুধু সীমানার মুক্তি ছিল না। আমরা যদি শোষণ মুক্ত সমাজ গড়তে না পারি, আমরা যদি গণতান্ত্রিক  ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বাবস্থা না গড়তে পারি । আমরা তো পাকিস্তান ধর্মরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম আর একটি ধর্ম রাষ্ট্রের জন্য না । আমরা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছি । এটি সমাজে যেমন চেয়েছি তেমন রাষ্ট্র বাবস্থায়ও।’

তিনি  বিশ্বাস করতেন সামরিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কোনো সংগঠন দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোপরি গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক হতে পারে না। তাই জিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়েই গড়ে তোলেন ১০ দলীয় ঐক্য মোর্চা। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী নেতা ছিলেন কাজী আরেফ। নব্বই-পরবর্তী সময়ে একই সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার হোন।

নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি বহুবার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন। সমাজকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় জাগ্রত করার কথা বলেন। প্রয়োজনে আরেকটি যুদ্ধের জন্যও তৈরি হতে বলেন। এসব নিয়ে  তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রা, মোহনা, সুগন্ধা, এখনই সময় তারকালোক, দৈনিক ইত্তেফাক ও আমাদের সময় পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর। কুখ্যাত রাজাকার যুদ্ধাপরাধী কথিত অধ্যাপক গোলাম আজমকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করা হয়। এ সময় কাজী আরেফ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে নেমে পড়েন সাহসী চ্যালেঞ্জে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে কাজী আরেফ তার সাথীদের নিয়ে রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে সামনে রেখে এ আন্দোলনে তিনি প্রধান রূপকারের ভূমিকা পালন করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এ আন্দোলন জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং একে জাতীয় দাবিতে পরিণত করার ফল হিসেবেই বাংলাদেশের কলঙ্কমোচনে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সম্ভব হয়েছে। সম্ভব হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদেও বিচার করতে।

 জাতীর এই বীর সন্তান ১৯৯৯ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কালিদাসপুরে সন্ত্রাসবিরোধী এক জনসভায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।

কাজী আরেফ আহমেদেও জীবন পরিপূর্ন ছিলো এক সংগ্রামী চেতনা নিয়ে। যে চেতনা নিয়ে ছিলো মানুষের মুক্তির গান, মানুষের মুক্তির সনদ। যে জীবন ছিলো শুধুই দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য নিবেদিত।

আমাকে হত্যা করলে

বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব

আমার বিনাশ নেই-

বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব

আমার বিনাশ নেই-

সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে

বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন

মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০